Satyajit Roy:’মেয়ে মানেই দেবী নয়, মানুষ!’ কয়েক দশক আগেই ধর্মান্ধতার গালে কষিয়ে থাপ্পড় দিয়েছিলেন সত্যজিৎ

বর্তমান ভারতে ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করার মতো দুঃসাহস কারও আছে বলে মনে হয় না। অথচ ধর্মান্ধতার বিশ্বাসকে অবলীলায় আজ থেকে ৬২ বছর আগেই প্রশ্ন করে গেছেন বাংলার “মাষ্টার মাইন্ড” সত্যজিৎ রায়। বাঙালি আজও যাদের নস্টালজিয়াকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে, সত্যজিৎ রায় সেইরকম একজন মাইলস্টোন। অথচ তাঁর বীক্ষণ, শিক্ষা আর চেতনা কী প্রবাহিত হয়েছে বাঙালির শিরায় ধমনীতে? উত্তরের সামনে মাথা নত করতে হয় আমাদের প্রত্যেককে। ধর্মীয় গোঁড়ামি, আর অন্ধবিশ্বাসের যূপকাষ্ঠে সত্যজিৎ রায় আঘাত করেছিলেন ‘দেবী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। কাহিনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের দেবী ছোটোগল্পকে সিনেমার পরিভাষায় রূপান্তরিত করেছিলেন সাহসিকতার সঙ্গে। ধর্ম ধ্বজাধারী পন্ডিতদের বিরুদ্ধে হয়েছিলেন খড়্গহস্ত। বিন্দুমাত্র ভয় ছিল না তাঁর, না তো ছিল আপোষ করার মানসিকতা। সত্যজিৎ রায়কে মানুষ চেনেন শুধুমাত্র তাঁর কর্মজীবন দিয়েই। কী ছিল এই দেবী গল্পে?
চাপিয়ে ধর্মবিশ্বাসের ওপর কুঠারাঘাত। অপু ট্রিলজির সারল্য, প্রাত্যহিক জীবনের কষ্ট ছিল না। জলসাঘরের মতো সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ নেই। তবে আছেন এক ধর্মান্ধ পুরোহিত ও জমিদার কালীকিংকর। মা কালীই তাঁর ধ্যান জ্ঞান। বাড়ির বড়ো ছেলে বিবাহিত একটি ছয় সাত বছরের সন্তান রয়েছে। ছোট ছেলে ইংরাজিতে মাস্টার্স সদ্য বিবাহিত। নব বিবাহিত বধূ দয়াময়ী বাড়িতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ঘটতে থাকে অলৌকিক শুভ পরিবর্তন। কালীকিংকরের মনের ভাবনা জন্মায় দয়াময়ী আসলে দেবী। বছর সতেরোর নিষ্পাপ সারল্যে ভরা বালিকা বধূর ওপর অনায়াসে চাপিয়ে দেওয়া যায় ধর্ম রক্ষার বোঝা। ধর্ম আর দেবীর অলৌকিকত্বকে সামনে রেখেই চলে সুনাম অর্জন। খ্যাতি, প্রতিপত্তি আর ক্ষমতার পাহাড় জমে কালী কিঙ্করের হাতে। জ্ঞানত বা অজ্ঞানত বাড়ির বধূকে ধর্মের ব্যবহারিক পন্য বানিয়ে ফেলেন জমিদার। দয়াময়ীর সরল বুদ্ধিতে প্রশ্নহীন আনুগত্যে শ্বশুরের পাতা ফাঁদে পড়ে যান। চলতে থাকে দেবীত্ব আরোপের খেলা। ঢুকিয়ে দেওয়া হয় রাশি রাশি অন্ধবিশ্বাসের স্তূপ।
অনেক রকম ব্যাখাই দেওয়া যায় এই কাহিনীর। স্বপ্ন তত্ত্বের ব্যাখা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাপে নিরীহ নারীর বঞ্চনার কথা, কিন্তু সর্বাধিক প্রাধান্য পায় ‘মগজাস্ত্রে ধর্মের বুলি ঢুকিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনার জিগির তোলা’ এমন ভাবেই ধর্ম বিশ্বাসকে গেঁথে দেওয়া মৃত্যু অথবা উন্মাদ হয়ে যাওয়া ছাড়া পথ না থাকে। পুরাষানুক্রমে ছড়িয়ে দেওয়া ধর্মান্ধতার বীজ।