পায়ের কাছে ফুল রাখতেই চিৎকার করে উঠলেন নজরুল, ভয় পেয়ে গেলেন সন্ধ্যা, ফিরে দেখা ইতিহাস
পাইকপাড়ার পুরনো বাড়ি। মেঝেতে তক্তপোষ পাতা। তার উপর বসে আছেন নজরুল ইসলাম। চোখে আগোছালো দৃষ্টি। বসে বসে কাগজ ছিঁড়ছেন। শিশুর মতো।

কৌশিক, কলকাতা: পাইকপাড়ার পুরনো বাড়ি। মেঝেতে তক্তপোষ পাতা। তার উপর বসে আছেন নজরুল ইসলাম। চোখে আগোছালো দৃষ্টি। বসে বসে কাগজ ছিঁড়ছেন। শিশুর মতো। নজরুল তখন বোধশক্তিরহিত। তাঁকে দেখতে এসেছেন কোকিলকন্ঠী সন্ধ্যা মুখার্জি।
হায় রে! যদি সুস্থ থাকতেন নজরুল, কী হত সেদিন! ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সুরের ঝর্নাধারায় ভেসে যেত স্বর্ণালি সন্ধ্যা। কবিতার গমগমে স্বরে ভরে উঠত চারপাশ। কত বিদগ্ধ আলোচনা, গান-সুর নিয়ে কাটাছেঁড়া। কিন্তু সর্বশক্তিমান সে রকম চাননি। কেন চাননি!
সন্ধ্যা ফুল নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর তখনও বিয়ে হয়নি। দিদি ও বৌদির ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে যান কবির বাড়ি। নজরুলগীতি তাঁর বড় প্রিয়, ছোটবেলা থেকেই। ঘুরতে ঘুরতে গাইতেন। সেই স্রষ্টাকে আজ দেখবেন, সে কি কম বড় কথা!
ঈশ্বরের পায়ে ভক্ত যেমন ফুল অর্পণ করে, সন্ধ্যাও ফুল নিয়ে এসেছেন। একটা বড় জুঁই ফুলের মালা। সঙ্গে চাঁপা আর বেল ফুল। মিষ্টি তো আছেই। সন্ধ্যা গিয়ে ভক্তের মতোই কবির পায়ে ফুল অর্পণ করলেন। নজরুল কাগজ ছিঁড়ছিলেন। ফুল দিতেই চিৎকার করে ওঠেন, ‘আঃ’। ভয় পেয়ে যান সন্ধ্যা। আশ্বস্ত করেন কবি পত্নী প্রমীলাদেবী। বলেন, ‘ভয় পেও না, উনি তোমাদের দেখে খুশি হয়েছেন। তাই চেঁচিয়ে উঠলেন’।
বিষাদে ভরে উঠল সন্ধ্যার মন। ভাবতে লাগলেন, ‘আজ কবি সুস্থ থাকলে কত কথা হত। গান হত। কবিতা পাঠ হত। আমার গান শুনে কী বলতেন কবি? খুশি হতেন? আমিও তো কবির কাছে গান শিখতে পারতাম’? কত কথাই যে সন্ধ্যার মনে ভেসে উঠছে।
তবে এই বিষাদ শুধু কবির জন্য নয়। কবি পত্নীকে দেখেও তাঁর মন ভারাক্রান্ত। প্রমীলা দেবীর কোমর থেকে পা পর্যন্ত পক্ষাঘাতে অবশ। কবির তক্তপোষের পাশেই চৌকিতে শুয়ে থাকেন। সেখানেই রান্নার আয়োজন। প্রমীলাদেবী নিজে হাতে রান্না করেন। তাঁর হাতের রান্না ছাড়া কবি যে কিছুই খেতে চান না। কবি পত্নীর ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ সন্ধ্যা। স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে তাঁর মন।
কবি আর কবিপত্নীর এমন অবস্থা সহ্য করতে পারেননি সন্ধ্যা। আর কোনওদিন যাননি পাইকপাড়ার বাড়িতে। তবে সেই স্মৃতি সযত্নে লালন করে রেখেছেন নিজের মনে। আর একটা আফশোস। ইস, যদি কবি সুস্থ হতেন, কত গান হত, কত কবিতা হত, কিছুই তো হল না।