Sanjukta Banerjee: আজও অদ্বিতীয় সংযুক্তার মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠান! কোথায় হারিয়ে গেলেন ‘বাঙালির দুর্গা’?

বাঙালি নিজের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সঙ্গে কখনও আপোষ করে না। দেশ হোক বা বিদেশ কোন বাঙালিকে দুর্গাপূজা নিয়ে প্রশ্ন করলে দুটি উত্তর আসবেই দুর্গা প্রতিমা আর মহালয়া অনুষ্ঠান। মহালয়ার ভোরের অনুষ্ঠান, বাঙালি আজও তাতেই মন্ত্রমুগ্ধ। ভাঙা ধুলোপড়া রেডিওটাও সেদিন সেজে ওঠে নতুন ভোরের আশায়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে চণ্ডীপাঠ শুনে ঘুম ভাঙে আম বাঙালির। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যার কোনও বিকল্প হয় নি। এমনকী বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পরিবর্তে মহানায়ক উত্তমের অনুষ্ঠানও বাঙালি প্রত্যাখ্যান করেছিল। সুতরাং বাঙালি যে ঐতিহ্য নিয়ে বড্ড নস্টালজিক তা প্রমাণিত।

মহালয়ার দিন সকালে বাঙালি দেবী দুর্গার মহিষাসুর মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পেয়েছিল নারী শক্তির এক অভূতপূর্ব জয়ের স্বাদ। দেবীর জন্ম, উত্থান,দেবতাদের স্তুতি ও তাদের শক্তিতে অস্ত্র প্রদান এক অনন্য গল্পের বুনন। এরপর রণরঙ্গিনী রূপে যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রবেশ,শক্তি প্রদর্শন ও অসুর নিধন এক সম্মোহনী কন্ঠের যাদুতে বাক্যহারা হয়ে যায় সমস্ত শ্রোতা।কল্পনায় তখন প্রত্যেক শ্রোতা পৌঁছৈ যান দেবলোকে।তবে বেতার অনুষ্ঠানের পর এক আকাঙ্ক্ষা জেগে থাকে প্রাণে একবার অন্তত সেই অনন্য সুন্দরী মায়ারূপিনী অসুর দলনী মহিষাসুর মর্দিণীকে চাক্ষুষ করার ইচ্ছে।

img 20220906 205308
প্রথমে যখন মানুষের জীবনে টেলিভিশনের আবির্ভাব হয়নি তখন রেডিওই সঙ্গী। টেলিভিশন আবিষ্কারের পর সেই দুরন্ত ইচ্ছে যেন বাঙালি মনে সঞ্চারিত হতে থাকল। তারপরও দূরদর্শন চ্যানেলেই সর্বপ্রথম সিদ্ধান্ত নিল সেই বৈপ্লবিক কান্ডের। টেলিভিশনের পর্দায় ফুটে উঠল এক নারী মূর্তি।যার চাহনি,মৌখিক অভিব্যক্তি,অলংকার আর অস্ত্রের ঝঙ্কারে শিহরিত হয়ে উঠত সমস্ত শরীর- সেই মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠান। তখন থেকেই কবি বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের গলায় চলতো চণ্ডীপাঠ সঙ্গে একজন নারী যিনি মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পুরো গল্পটিকে অভিনয় করে দেখাতেন।

টেলিভিশন পর্দায় দুর্গা রূপে যিনি অসাধ্য সাধন করলেন তিনি সংযুক্তা ব্যানার্জি। মানুষ তার অভিনয়ে হতবাক হয়ে গেলেন। দুর্গা ও মানব রূপী দুর্গার ব্যবধান নির্নয় করা দুরহ হয়ে উঠল। ১৯৯৪ সালে দেবী দুর্গার বিভিন্ন রূপ নিয়ে টেলিভিশনে প্রথমবার সামনে আসেন সংযুক্তা। সেই বছর তার নিপুণ নিঁখুত দোর্দণ্ড-প্রতাপ অভিনয়ে এক চিরায়ত ছবি এঁকে গেলেন দর্শকের হৃদয়ে । তারপরে বহু বছর ধরে তিনিই টিভির পর্দায় চালিয়ে নিয়ে গেছেন ‘মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠান’।

প্রথম অভিনয়ের শ্রী শিক্ষায়তনে প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন সংযুক্তা। মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠানের প্রযোজক এবং পরিচালকের কয়লার মধ্যে হিরে টিকে বেছে নিয়েছিলেন। এই অনুষ্ঠান প্রচারিত হওয়ার আগে বেশ কয়েক মাস ধরে তালিম চলত। তালিম দিতে আসতেন একজন ফাইট মাস্টার। তার হাতেই সংযুক্তা শিখেছিলেন ত্রিশূল ধরা,অসুরের সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধ দৃশ্য।

সময় বদলেছে। এখন টেলিভিশনে উন্নত ঝাঁ চকচকে ভিএফএক্সের কামাল, গহনা থেকে সেট সেখানেও লেগেছে আধুনিকতার হাওয়া। চিত্রনাট্যেও এসছে যার পর নাই বদল। মহালয়ার আসল গল্প প্রায় হারিয়ে যাওয়ার পথে। দুর্গা রূপে এসেছে নায়িকা মুখ, অসুরের থেকে সুপুরুষ আর কেউ নেই। মেকাপে এসেছে বহু জৌলুস। তবু বাঙালি আজও খোঁজে সংযুক্তা ব্যানার্জির মতো বহুমুখী প্রতিভাকে, যিনি সাধারণ সাজে শুধু অভিনয় দিয়ে মানবী রূপ ছেড়ে দেবীত্বে উন্নীত হন। কোথায় হারিয়ে গেলেন সংযুক্তা?

সংযুক্তা এখন কানাডাবাসী। নিজের একটি নাচের স্কুল রয়েছে তার। পুরো পরিবার নিয়ে কানাডাতেই বসবাস করছেন বাংলার দূর্গা। বিদেশে বসবাস করলেও তিনি তার বাঙালিয়ানাকে ভুলে যাননি। পূজার কটা দিন তার নাচের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়েই একাধিক অনুষ্ঠান করে কাটান। তবে বাঙালি সেই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত।তিনি কিন্তু এখনো নিজের সত্তাকে সমানতালে ধরে রেখেছেন।




Back to top button