Uttam-Soumitra: “আমাকে মাফ করে দাও”, একটা ভুলেই উত্তম কুমারের পা ধরে ক্ষমা চেয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা: ষাটের দশক মানে সেকাল এবং কিছুটা একালের মানুষ ভেসে যেত ভালোবাসার আবেগের নদীতে। এই আবেগের বহমান জলধারায় যেন ডুব দিতে মন চায় অনেকের। তবে সেটা সেটা উত্তম-সুচিত্রা (Uttam-Suchitra) হোক কিংবা উত্তম-সাবিত্রী (Uttam-Sabitri), বাঙালি বরাবর ভালোবেসেছে এই পর্দার আবেগি জুটিদের। কিন্তু উত্তমের কথা উঠতেই বিপরীতে যে সর্বদা কোনও মহিলাই থাকবে এমনটা নয়। আসলে, সুচিত্রা এবং সাবিত্রীর মতোই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের (Soumitra Chatterjee) সঙ্গেও উত্তমকুমারের বন্ধুত্ব ছিল বেশ গলায় গলায়।

উল্লেখ্য, যারা গল্প তৈরি করে এবং যারা গল্প দেখে তাঁদের প্রত্যেকের কাছে উত্তম-সৌমিত্র (Uttam Kumar and Soumitra Chatterjee) একটা আবেগ। এখন সময়ের সঙ্গে আবেগ বসত দর্শকদের চোখ দিয়ে জল না পড়লেও তাঁদের চর্চার ছায়া এখনও মানুষকে ঘিরে রয়েছে। কিন্তু পর্দার আড়ালে কেমন ছিল এই দুই বন্ধুর সম্পর্ক? এই নিয়ে মাঝে মধ্যেই দানা বাঁধে সন্দেহ। ফলত নানা মুনির, নানা মতও ভেসে বেড়ায় বাতাসে। 

উত্তম কুমার কার্যক্ষেত্রে সৌমিত্রের থেকে কিছুটা সিনিয়র হলেও দু’জনের মধ্যে খুব গভীর বন্ধুত্ব ছিল। যেহেতু উত্তম কুমার সৌমিত্ররের কিছুটা আগেই টলিপাড়ায় প্রবেশ করেছিলেন তাই তাঁর সক্রিয়তাও ছিল দ্বিগুণ। আর সমস্ত কর্মস্থলের মতো সিনেমার জগতেও এই রক্তমাংসের মানুষগুলোর মধ্যেও বন্ধুত্ব, প্রেম, ঝগড়া, ঈর্ষা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা সমস্তই বিদ্যমান। শ্যুটিংয়ে গিয়ে হয় তো পরিচালকের মশারি টাঙানোর জন্য দড়ি পাওয়া যাচ্ছে না, সঙ্গে সঙ্গে সাবিত্রী নিজের চুল বাঁধার দড়ি দিয়ে নিজের হাতে মশারি টাঙিয়ে দিলেন, খানিকটা এরকমই সম্পর্ক ছিল তাঁদের সবার মধ্যে। একদিকে গভীর বন্ধুত্ব আবার অন্যদিকে লাইমলাইট নিয়ে রাগারাগি, অভিমান, তিক্ততা, ঈর্ষার জায়গাও যে ছিল তা কখনওই অস্বীকার করেননি সৌমিত্রবাবু।

uttam and soumitra1

তাঁর কথায়, “এই লাইনে এসে উত্তম’দা কীভাবে নিজেকে কন্ডাক্ট করেন, এগুলো যখন দেখতাম, আমি উপলব্ধি করতাম যে আমি সেভাবে পারিনা। সুতরাং উত্তম’দাকে দেখে আমায় অনেক কিছু শিখতে হয়েছে। ঈর্ষার ব্যাপারটা প্রোডাক্টিভ।” একবার মিটিংয়ে বসেছিলেন তিনজন কনভেনর, সত্যজিৎ রায়। উত্তমকুমার। সৌমিত্র চটোপাধ্যায়। এই তিন তাবড় তারকা গোল টেবিলে বসতেই ছেয়ে গিয়েছিল অন্ধকার। লোডশেডিং। ফলত, কাজের বিরাট ক্ষতি। ঠিক হল সরকারের কাছে একটা ডেপুটেশন দেওয়া হবে। সেদিন সত্যজিৎ রায়ের গাড়িতে ছিলেন তিন মহারথি। গাড়ির ব্যাকসিটে উত্তম ও সৌমিত্র এবং গাড়ির সামনের সিটে খোদ পরিচালক অর্থাৎ সত্যজিৎ রায়। হঠাৎ করেই উত্তম কুমার বলে উঠলেন “ কি মানিকদা আমাকে আর কোনও ছবিতে নিচ্ছনা কী ব্যাপার?” সত্যজিৎ নাকি বলেছিলেন, “এই বয়েসে রোল পাওয়া মুশকিল” তখন সৌমিত্র মজা করে বলেছিলেন, “না না উত্তমদা ছাড় তো! তুমি আর আমি যখন বুড়ো হব তখন সিনেমা জগতে আবার ভালো বুড়ো আসবে।” হেসে উঠলেন সকলেই। এরপরও নাকি বেশ কয়েকবার মহানায়ক দুঃখ প্রকাশ করেছিল তাঁর পুলুর কাছে।

একদিন দুজনে হলে গিয়েছিলেন, নিজেদের ‘দেবদাস’ দেখতে। কিছুক্ষণ পর সৌমিত্র উত্তমকুমারের হাঁটুতে চাপড় দিয়ে বলে “কী হচ্ছে বলত কোনও সংলাপ যে বুঝতেই পারছিনা।” পরিপ্রেক্ষিতে মহানায়ক বলেন “আমি তোরটা তাও বুঝতে পারছি, আমার গুলো একদমই বুঝতে পারছি না।” কিন্তু এমন কী হল যে সেই সৌমিত্রই উত্তমকুমারের পায়ে হাত দিয়ে ক্ষমা চাইল? এমন কী হয়েছিল সেদিন? 

সৌমিত্র আজীবনই বামপন্থী চিন্তাধারার মানুষ। ৭০’র দশকে প্রত্যেক বছর বসুশ্রীতে ১লা বৈশাখের উপলক্ষে একটা অনুস্থান আয়োজিত করা হত। সেখানে সমস্ত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা আসতেন। গল্প হত, কোলাকুলি হত। একবার অভিনেতা সৌমিত্রের পৌঁছতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। সেখানে পৌঁছে তিনি দেখলেন, অভিনেতা ভানু বন্দ্যপাধ্যায়ের সঙ্গে বসে গল্প করছেন উত্তমকুমার। দুইজন দুই শিবিরের। তখন দেখা হলেই হত ঝগড়াঝাঁটি, তর্ক-বিতর্ক, বাকযুদ্ধ। কিন্তু উত্তম ও ভানু দিব্যি গল্প পেতেছেন। সৌমিত্র এগিয়ে গিয়ে ভানুকে প্রণাম করলেন। পাশেই তাঁর ‘উত্তমদা’। কিন্তু তা হলে কী হবে বিরোধী শিবির বলে কথা। হাত ধরে শুধুমাত্র বললেন ‘শুভ নববর্ষ’। উত্তম বলেলন “বড় ভাই, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে পারিস না?” দাদার অভিমান যেন ভাইয়ের যাবতীয় বিরোধকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। লজ্জায় অনুতাপে উত্তমের পা জড়িয়ে ধরে সৌমিত্র বললেন “ আমাকে মাফ করে দাও উত্তমদা, আমার অন্যায় হয়ে গেছে।” তারপর তাঁর পুলুকে (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) হাত টেনে জড়িয়ে ধরলেন তাঁর উত্তমদা।”




Back to top button