Uttam Kumar: পাঁচ সিকের ফ্লপ মাস্টার, সুচিত্রা জল্পনায় ঘেরা জীবন! কেমন ছিল সিনেপাড়া দিয়ে ‘উত্তম যাত্রা’?

থিয়েটার অনুরাগী অরুণের শখ ছিল রুপোলি পর্দায় অভিনয় করার। ঝোঁকটা ক্রমেই বেড়ে চলল। বিড়ালের ভাগ্যে শিঁকে ছেঁড়ার মতোই একটি সুযোগ এল। ১৯৪৭ সালে হিন্দি চলচ্চিত্র ‘মায়াডোর’-এ অভিনয়ের সুযোগ৷ তবে নেহাতই এক্সট্রার রোল। অনভিজ্ঞ একজন অভিনেতার কপালে এর চেয়ে বেশি আর কী বা জুটবে! মাত্র পাঁচ সিকিতে দৈনিক ভিত্তিতে ওই ছবিতে অভিনয় করলেন অরুণ। কিন্তু নিয়তি! ‘মায়াডোর’ মুক্তি পেল না। ‘৪৮ সালে পেলেন আরেকটি সুযোগ, ‘দৃষ্টিদান’ ছবিতে নায়ক চরিত্র। অসিতবরণের যুবক চরিত্র দর্শকমনে তেমন জায়গা করতে পারল না। তবে তাতেও দমে গেলেন না। ততদিনে থিয়েটার থেকে সিনেপাড়া পরিচিতি কিছুটা বেশি। পরের ছবি পেলেন, নাম ‘কামনা’। ১৯৪৯ সালে মুক্তি পেল ছবিটি, কিন্তু একেবারে সুপার ফ্লপ। কোন লাভের মুখ দেখলেন না নায়ক। এদিকে পরিচালক প্রযোজক দের ভরসা কমে আসছে। সুযোগের দরজা ক্রমশ সংকীর্ণ। তবু ভাগ্য দেবতা প্রসন্ন হলেন না। পরের দুই ছবি ‘মর্যাদা’ ও ‘ওরে যাত্রী’ও চলল না। চারিদিকে রটে গেল টলিপাড়ার ফ্লপ নায়ক। কার কথা বলছি, তা আর বলে দিতে হবে না নিশ্চয়ই! সর্বকালের সেরা নায়ক উত্তম কুমার ছিলেন প্রথম জীবনে ফ্লপ মাস্টার।
১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কলকাতায় তার জন্ম। পরিবারের দেওয়া নাম ছিল অরুণ কুমার। গিরিশ মুখোপাধ্যায় রোডের একটি ঘরে কোনক্রমে দিন কেটে যায় অরুণের।ভরসা বলতে বাড়িটি পৈত্রিক। অভাব অনটনের সংসার। দিন আনা দিন খাওয়া। বাবা সাতকড়ি চাটুজ্যের চেষ্টায় কোনক্রমে সংসার চলছে। অসহায় অরুন উপার্জনে নেমে পড়লেন বাড়ির অসহায় অবস্থা কাটাতে। পড়াশোনা তখনও শেষ হয়নি। পাশাপাশি চলল কাজের খোঁজ। কী বা পারেন করতে, যাত্রা পাশাপাশি গানের শিক্ষকতা শুরু করলেন। সবচেয়ে লোভনীয় প্রস্তাব পেলেন অল্প দিনেই। গান শেখাতে হবে গাঙ্গুলী বাড়ির মেয়ে গৌরী দেবীকে। বেতনও বেশ ভালো, মাসে ৭৫ টাকা। আগেই চেনাজানা হলেও শিক্ষকতা করতে গিয়ে নতুন রসায়ন তৈরি হল উত্তম-গৌরীর। ১৯৫০ সালের ১ জুন অরুণের ঘর আলো করে এল গৌরী। বিয়ে তো করলেন কিন্তু রোজগার? তবে ছবি পাওয়া বন্ধ হল না। একের পর এক ছবি পেতে থাকলেন সুপুরুষ ভদ্রলোক। ইন্ড্রাস্ট্রিতেই রটে গেল দুর্নাম। ফ্লপ মাস্টার বলে ডাকা শুরু হল।
হেরে যাননি অরুণ কুমার। ঠিক করলেন, নাম বদলে ফেলবেন। নতুন ছদ্মনাম নিলেন অরূপ কুমার। নাম বদলিয়েও ভাগ্য বদল হল না । তবে কথায় আছে রতনে রতন চেনে। তেমনই একদিন শ্যুটিংয়ের ফাঁকে পাহাড়ি সান্যাল ডেকে উঠলেন “‘তুমি অরুণ নও হে, তুমি যে উত্তম, উত্তম কুমার।” নামটি বেশ মনে ধরল পরিচালকদের। নতুন পরিচয় পেয়ে অরুণের উত্তম হল। যদিও হাতে থাকা ছবি সঞ্জিবনী ফ্লপ করল ফের। তবে নতুন নায়ক উত্তমের নাম আনাচে কানাচে। ১৯৫৩ সালের মুক্তি পেল নির্মল দের ছবি ‘সাড়ে ৭৪’। নায়ক উত্তম কুমার। মুক্তির পর সকলেই বলল নতুন জুটি এসেছে পর্দায় তবে তাদের নিয়ে উচ্ছ্বাস বেশি ছিল না।বয়স্করা মজষ তুলসী চক্রবর্তী আর মলিনা দেবীকে বাহবা দিতে লাগলেন। কমেডি নাকি বাজিমাৎ করেছে, রোমান্স নাকি একেবারে খারাপ। তবে সমালোচনা এড়িয়েও ছবি চলল রমরমিয়ে।
উত্তম তখন আড়ালে। কাউকে কিছু বললেন না মুখ ফুটে। তবে সাড়ে চুয়াত্তর-এর টের পাওয়া গেল পরের বছর। অশ্বমেধের ঘোড়া যেন যুদ্ধ জয়ের জন্য বেড়িয়েছে। তাকে বাঁধে এমন সাধ্য কার? ১৯৫৪ সাল যেন উত্তম যুগের শুরু। একবছরে মুক্তি পেল উত্তম অভিনীত ১৪টি ছবি, তার মধ্যে সাতটিই সুচিত্রার সঙ্গে জুটি বেঁধে। ‘ওরা থাকে ওধারে’ ছবি দিয়ে উত্তম-সুচিত্রা জুটি পাকাপাকিভাবে দর্শক হৃদয়ে স্থান করে নিল। এক কথায় মহানায়ক মহানায়িকার জুটি। কী অভিনয়! অনবদ্য রসায়ন আর অসাধারণ চোখের দৃষ্টি যেন দর্শককে মন্ত্র মুগ্ধ করে ফেলল।২২ বছর ধরে মুক্তি পেয়েছে উত্তম-সুচিত্রা জুটির সর্বমোট ৩১টি ছবি। মোট ৪৬ জন নায়িকার সঙ্গে অভিনয় করেছেন উত্তম আর অভিনয় জীবনে ‘দৃষ্টিদান’ দিয়ে শুরু করে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ৩৩ বছরে বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে প্রায় আড়াইশো ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। চলচ্চিত্র জগতে একম -অদ্বিতীয়ম কিংবদন্তি মহানায়ক উত্তম কুমারকে বেঙ্গল ক্রনিকলের পক্ষ থেকে জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য।