পাহাড়ের কোলে সুন্দর একটা গ্রাম, যেখানে যাবার নেই কোনো রাস্তা! পৃথিবীর বুকে এ যেন এক আশ্চর্য
যত দিন যাচ্ছে ততই ব্যস্ত হয়ে পড়ছি আমরা সকলে। ছোট বেলায় খেলা থেকে শুরু করে পড়াশোনা আর বড় হয়ে চাকরির মধ্যে জড়িয়ে যেন হাঁপিয়ে ওঠে মনপ্রাণ। আর যখন দমবন্ধ হয়ে আসে শহরের পরিবেশে তখনই একটু শান্তির হাওয়া খুঁজতে অনেকেই ছুটে যায় নিতান্ত কোনো গ্রাম্য পরিবেশে। ট্রেনে করে বা গাড়িতে ছোড়ে দূরের কোনো গ্রামে নিরিবিলিতে কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে মনকে হালকা করে নেওয়া যায়। কিন্তু পৃথিবীতে এমন এক গ্রাম রয়েছে যেখানে যাবার কোনো ঠিকমত রাস্তাই নেই।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা যখন দূষণমুক্ত পরিবেশ এর জন্য লড়াই করছি, ইতালির এই গ্রামটি আমাদের ভবিষ্যতের পথ দেখাতে পারে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে মোড়া ছিমছাম একটি গ্রাম। স্কুল-হাসপাতাল রেস্তোরাঁ সবই আছে। শুধু যানবাহন চলাচলের কোনো রাস্তা নেই। শুনে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। এটি তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের দরিদ্র গ্রামের গল্প নয়। ইউরোপের অন্যতম ধনী দেশ ইতালির বুকে রয়েছে এই গ্রামটি। ইতালির দ্বিতীয় উচ্চতম গ্রাম স্যাময় (Chamois)। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তার উচ্চতা প্রায় ১৮১৮ মিটার। তবে যাতায়াতের রাস্তা না থাকলেও বাসিন্দাদের তাতে কোনো আপত্তি নেই, পাহাড়ের ঢাল বেয়েই যাতায়াত করেন সেখনাকার মানুষ।
অষ্টাদশ শতকে হাতেগোনা কিছু পরিবার এসে এই গ্রামে থাকতে শুরু করে। পরে ধীরে ধীরে বেড়েছে জনবসতি। একসময় সেখানে ৩০০- ৪০০ জনের বেশি মানুষ বসবাস করত, তবে বর্তমানে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ২০০০ এর কাছাকাছি। এমনটা না যে সরকারের উদাসীনতা বা অর্থনৈতিক কারণে গ্রামের রাস্তা তৈরি হয়নি। বরং, ইতালির সরকার বারবার চেষ্টা করেও গ্রামবাসীদের সম্মতি নিতে পারেনি রাস্তা তৈরির জন্য।
১৯৫৫ সালে সরকার প্রস্তাব দেয় গণভোট আয়োজন করার, সেখানেও প্রত্যেক গ্রামবাসী এক বাক্যে সড়কপথের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু তারা বাকি দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চেয়েছিল এমন টাও না। তাই তার বদলে ৯৫ শতাংশ মানুষের অনুমতি নিয়ে তৈরি হয় নতুন একটি পরিবহন ব্যবস্থা। সেটি ছিল রোপওয়ে পরিবহন। দড়িতে ঝোলানো চেয়ারে বসেই গ্রাম থেকে বাইরের জগত এবং বাইরের জগত থেকে সময় গ্রামে যাতায়াত করতেন মানুষ।
প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইতালি যখন মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট সরকারের অত্যাচার এবং পার্টিজান কমিউনিস্টদের সশস্ত্র আন্দোলনে ইতালির রাস্তা রক্তাক্ত হচ্ছে, স্যাময়ের বাসিন্দারা তখন ছিলেন দিব্যি শান্তিতে। গ্রামে যাতায়াত এর কোন রাস্তা না থাকায় ফ্যাসিস্ট বা পার্টিজান কেউই এখানে পৌঁছাতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মিটে গেলে গ্রামবাসীরা সমগ্র ইতালি সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাননি। তাদের মতে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ উন্নয়নের নামে পরিবেশ এবং সংস্কৃতি ধ্বংস করছে, তারা এর বিরোধী। তাই নিজেদের সংস্কৃতিকে বাঁচাতে তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এমনকি, কিছু বছর আগে ইতালি সরকার বিদ্যুতের লাইন পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা করে, কিন্তু সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন গ্রামবাসীরা। তারা নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছেন আস্ত একটি জলবিদ্যুৎ প্লান্ট।