Mumbai attack: মুম্বই হামলার ১৩ বছর, আক্রান্তদের স্মৃতির পাতায় আজও দগদগে সেই রক্তঝরা ক্ষতের ইতিহাস
মুম্বাইয়ের তাজ হোটেল, ওবেরয় হোটেল, লিওপোল্ড ক্যাফে, ছত্রপতি শিবাজী বাস টার্মিনাসে ভয়াবহ জঙ্গি আক্রমণের পর কেটে গেছে তেরোটা বছর। ২০০৮ সালের এই দিনেই ভয়ঙ্করতম জঙ্গি আক্রমণের(terrorist attack)কবলে পড়েছিল বানিজ্যনগরী মুম্বাই। মুম্বাইয়ের এই জঙ্গি হামলায়(Mumbai Attack) নিহত হয়েছিলেন অসংখ্য পুলিশকর্মী থেকে সাধারণ মানুষ। তবে তাদের মধ্যেও এমন কয়েকজন আছেন যারা ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছিলেন সেই বিপদজনক পরিস্থিতি থেকে। তবে আতঙ্ক আজ এই তেরো বছর পরেও তাড়া করে বেড়ায় তাদের। ২০০৮ এর ছাব্বিশ এগারোয় ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা এমনই চারজন প্রতক্ষ্যদর্শীর মুখ থেকে সরাসরি জেনে নেওয়া যাক সেই দিনের ঘটনা।
সোনালি চ্যাটার্জী(সংবাদমাধ্যমকর্মী, দিল্লী)
আজ থেকে তেরো বছর আগের ঘটনা হলেও কিছু স্মৃতি এখনও টাটকা। নভেম্বর ছাব্বিশের সকালে আমরা গোটা সম্পাদকীয় দল তাজ হোটেলে চেক ইন(check in) করি। তাজের কফি শপ এবং বিজনেস সেন্টারগুলিতে পরপর মিটিং চলছিলো। রাত সাড়ে নটায় ডিনার(dinner) সেরে ঘরে ফেরার পর আমার বসের ফোন আসে। তিনি বলেন যে তিনি গুলির শব্দ শুনেছেন এবং আমাকে ঘরের দরজা বন্ধ রাখতে বলেন। রাত ১০.৪৫ এ একজন তাজের কর্মী ফোন করে বলেন ঘরের সমস্ত আলো নিভিয়ে দিতে এবং দরজা না খুলতে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে গেলাম যে কি ঘটেছে কিন্তু তার আগেই ফোন কেটে গেল। তারপর বেশ কিছু ঘন্টা অন্ধকার ঘরে বসে আমরা বাইরে বন্দুকের আওয়াজ এবং বিষ্ফোরণের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। সেইসময়ে আমাদের সংবাদ সংস্থা চারজনকে নিয়ে ইমেলে একটি গ্লোবাল টাস্ক ফোর্স(global task force) গঠন করে যেখানে পনেরো মিনিট অন্তর অন্তর আমরা ঠিক আছি কিনা রিপোর্ট করতে হচ্ছিলো। হঠাৎই আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে যায় জঙ্গিরা। সেই সময়ে আমার বস ওখান থেকে বেরিয়ে যাবার নির্দেশ দেন। ঘর থেকে বেরিয়ে আমি একটা শুনশান করিডরের ফায়ার এক্সিটের(fire exit) দিকে হাঁটতে শুরু করি। যখন সেই সরু ফায়ার এসকেপ দিয়ে যাচ্ছিলাম বন্দুকের আওয়াজ আরো বাড়তে লাগলো। বারবার মনে হচ্ছিলো যে এখানে কোন জঙ্গি যদি চলে আসে তবে কি করবো আমি! এরপর একটা দরজার সামনে পৌছলাম যেখানে লেখা ছিল যে দরজা ঠেললেই অ্যালার্ম(alarm) বেজে উঠবে। কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে ঠেললাম সেই দরজাটা। দেখলাম তাজের পিছন দিকে চলে এসেছি। আরো আধঘণ্টা পর আমার বস এবং আরো তিন সহকর্মী এসে পৌছলেন। শুনলাম তিনি বেশ কয়েকটি মৃতদেহের ওপর দিয়ে লাফিয়ে বেরোতে পেরেছেন! এই ঘটনার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আর কখনো কথা বলবো না এই দিনের বিষয়ে।
বর্ষা তলরেজা কনসরা (পিআর প্রফেশনাল, মুম্বাই)
আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আরেক বন্ধুর জন্মদিন উদযাপন করতে বেরিয়েছিলাম। গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ার সামনে থেকে আমরা একটা নৌকো ভাড়া করে তাতে আমাদের পার্টির সরঞ্জাম এবং খাবারদাবার নিয়ে উঠি। আমাদের প্ল্যান ছিল লিওপোল্ড বা ইন্ডাস ক্যাফেতে পার্টি করার। রাত নটা নাগাদ আমাদের নৌকো ডকের(dock) কাছাকাছি ফিরিয়ে আনছিলো আমাদের। এক বন্ধু তার ড্রাইভারকে ফোন করলে সে জানায় জঙ্গি আক্রমণের জন্য ওই জায়গায় ওই মুহূর্তে যাওয়া বারণ। এই কথাকে প্রথমে আমল দিইনি আমরা। কিন্তু তারপর ডকের কাছাকাছি আরেকটি পেট্রোল বোট(patrol boat)আমাদের এসে একই সতর্কবার্তা শোনায়। তখন আমরা তাড়াতাড়ি নৌকার সব আলো নিভিয়ে মিউজিক বন্ধ করে নৌকায় মাথা নিচু করে শুয়ে পড়লাম। এইসময়ে আমাদের আত্মীয়রা বারবার ফোন করছিলেন কিন্তু তারাও সঠিক দিশা দেখাতে পালছিলেন না। এরপর মাঝরাত নাগাদ কয়েকজন পুলিশকর্মী আমাদের বললেন ইয়চ ক্লাবে নিরাপদ আশ্রয় নিতে। কিন্তু সেখানে ঢুকতে গিয়েই শুনতে পেলাম গুলির শব্দ। ভেতরে ঢুকে দেখলাম সবাই উদগ্রীব হয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে। এরপর পরের দিন সকালে অবশেষে নিরাপদে বাড়ি ফিরলাম।
অনুপ শেঠ (সিনিয়র স্টাফ, তাজ হোটেল, মুম্বাই)
তেরো বছর আগের ওইদিনের স্মৃতি আমার মনে এখনো টাটকা, মনে হয় গতকাল ঘটেছে। ওইদিন রাত নটা পনেরো অবধি সব স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম এক অতিথির বিয়েতে বাজি ফাটছে। অচিরেই বুঝলাম যে ওটা বন্দুকের আওয়াজ। ঠিক যে মুহূর্তে আমি ম্যানেজারকে চাবি দিলাম দরজা বন্ধ করার জন্য, আমরা দেখলাম একজন জঙ্গি প্রবেশ করছে, তাকে একেবারে সাধারণ কলেজ ছাত্রের মতো দেখতে। মাথায় কমলা রঙের টুপি পরা সেই জঙ্গি সিলিংয়ের দিকে বন্দুক তাক করে ফায়ার করলো। দুর্ভাগ্যবশত আমরা করিডরের আলো নেভানোর সুযোগ পেলামনা কারণ সুইচ ছিল মূল দরজার দিকে। এরপর আমরা পরের সাত ঘন্টা সকলকে দোতলার চেম্বারে সরিয়ে দিলাম। এরপর রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ বেরোনোর অনুমতি পেলাম। কিন্তু তখনও আমাদের ফ্লোরে গুলির শব্দ শুনলাম। তখন একটা ফায়ার এক্সিট দিয়ে আমি বেরোনোর চেষ্টা করলাম কিন্তু সেখানকার সিলিংটা খুব কাঁপছিলো। তাড়াতাড়ি টেবিলের তলায় আমরা লুকিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর হোটেলের সিকিউরিটি ম্যানেজার সহ কিছু উদ্ধারকর্মী এসে আমাদের বললেন লবি দিয়ে হোটেলের বাইরে বেরিয়ে যেতে। তখন আনুমানিক ভোর পাঁচটা। এই ঘটনায় আমি আমার প্রিয় বন্ধু শেফ(chef) হেমন্তকে হারিয়েছি। তার তখন মাত্র চব্বিশ বছর বয়স ছিল।
অমৃতা রায়চাঁদ(সেলিব্রেটি শেফ, মুম্বাই)
ছাব্বিশ এগারোয় আমার জন্মদিন ছিল এবং সেই কারণেই আরো ভীতিকর এই দিনের অভিজ্ঞতা। আমরা তাজমহল হোটেলের ওয়াসাবিতে পরিবারের অন্যান্য লোকজনদের সঙ্গে ছিলাম। রাত সাড়ে নটায় আমাদের টেবিল বুকিং ছিল। আমরা ভেবেছিলাম তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে হারবার বারে আরো এক বন্ধুর পার্টিতে যাব। কিন্তু ওয়াসাবির ওপরেই আমার পরিবারের স্যুইট থাকাতে সে প্ল্যান বাতিল করতে হয়। প্রথম রাউন্ড ড্রিঙ্কের পরেই হঠাৎ বাজি ফাটার মতো একটা আওয়াজ শুনি আমরা। রিসেপশনে ফোন করতে তারা আমাদের ঘরেই থাকতে বলেন। জানলা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাজের পর্চে একটা দেহ টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।জানতে পারলাম যে হারবার বারে আমি যেতে চাইছিলাম সেখানেই প্রথম গুলি চলে। এরপর সারারাত অন্ধকারে কাটানোর পর সকাল সাড়ে সাতটায় রুমের জানলা দিয়ে আমার স্বামী হাত নাড়ালে আমাদের এসে উদ্ধার করা হয়। ওই দুঃস্বপ্নের রাতে ভেবেছিলাম আমার একবছরের ছেলেকে আর দেখতে পাবো না।