‘শ্যাম্পু’ কি ইংরাজী শব্দ? জন্ম কিন্তু এক বাঙালির হাত ধরেই
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীনকালে নারীরা মাথার চুল পরিষ্কারের জন্য রিঠা ও শুকনো আমলকির সঙ্গে শিকাকাই, জবা ফুল ফুটিয়ে নিজেদের শ্যাম্পু তৈরি করে নিতেন। চুল হত চকচকে ও মসৃণ। মাথার ত্বক হত জীবাণুমুক্ত। তখনও বাজারে কৃত্রিম শ্যাম্পু বিক্রি শুরু হয়নি। আজ থেকে প্রায় 200 বছর আগে “শ্যাম্পু” শব্দটি ইংরেজি ভাষায় প্রবেশ করে। ইউরোপে শব্দটি নিয়ে গিয়েছিলেন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি থেকে ইউরোপে যাওয়া এক বাঙালি মুসলিম। নাম শেখ দীন মুহাম্মদ।
১৭৮৪ সালে ক্যাপ্টেন গডফ্রে বেকারের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডের কর্কে চলে গিয়েছিলেন দীন মুহাম্মদ। ইউরোপে গিয়ে প্রথমেই ইংরেজিটা ভালো করে রপ্ত করে নিয়েছিলেন। কাজ করতে শুরু করেছিলেন স্থানীয় কিছু চিকিৎসকের সঙ্গে। ১৭৮৬ সালে তিনি বিয়ে করেন আইরিশ মেয়ে জেনি ডলির সঙ্গে। বিয়ের পরেই দীন মুহাম্মদ লন্ডনের একটি “বাষ্প স্নান” পার্লারে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। এই পার্লারটিতে জল ফুটিয়ে বাষ্প তৈরি করে, সেই বাষ্পে স্নান করানো হতো গ্রাহকদের। দীন মুহাম্মদ নিজের আবিষ্কৃত বাষ্প স্নানের পদ্ধতি চালু করে এই পার্লারে। যার নাম দিয়েছিলেন চাম্পুই (Champooi)। হিন্দি ভাষার চাম্পু বা চাম্পো শব্দ থেকে দ্বীন মুহাম্মদ শব্দটি নিয়েছিলেন। চাম্পু বা চাম্পো শব্দ দুটির উৎস হল সংস্কৃতি ভাষার “চপতি” শব্দ। যার অর্থ হলো মাসাজ করা।
দীন মুহাম্মদ এর বাষ্প স্নান পদ্ধতি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে যাওয়ার পর, পার্লারের চাকরি ছেড়ে ১৮১৪ সালে ব্রাইটনে নিজের প্রথম “শ্যাম্পুইং” পার্লার খুলেছিলেন। বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি হিসাবে “শ্যাম্পুইং” কে সারা ইংল্যান্ডের ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ব্যবসায়িক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন দীন মুহাম্মদ। “শ্যাম্পুইং” -এ উৎসাহী মানুষকে ফুটন্ত জল থেকে বেরিয়ে আসা বাষ্প দিয়ে ভেজানো হত। এক্ষেত্রে সমুদ্রের লবণাক্ত জল ব্যবহার করা হতো। পরে মানুষটির মাথায় ও গায়ে ভালো করে মাখিয়ে দেয়া হতো মুহাম্মদ এর আবিষ্কৃত ভেষজ উপাদান। তারপরও মালিশ করা হতো ১৫ মিনিট থেকে আট ঘণ্টা। সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়ে যেত মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত। এমনকি বড় চুলের ক্ষেত্রে জটও আপনা আপনি ছেড়ে যেত। তরতাজা হয়ে পার্লার থেকে বেরিয়ে আসতেন দীন মুহাম্মদের ক্লায়েন্টরা।
দীন মুহাম্মদের ‘শ্যাম্পুইং’ এর সুনাম ছড়াতে শুরু করেছিল খুব দ্রুত। ব্রিটেন এর কাগজগুলিতে তা নিয়ে লেখালেখিও শুরু হয়ে গিয়েছিল। নামি কাগজে লেখা হয়েছিল, ভারতীয় চিকিৎসকের মিরাকেল ‘শ্যাম্পুইং’ বাত, প্যারালাইসিস, অভিসন্ধিতে ব্যথা, মচকানো ব্যাথা মত রোগ অবিশ্বাস্যভাবে সারিয়ে দিয়েছে। বিতর্কের ঝড় উঠেছিল ইংল্যান্ড জুড়ে। ইংল্যান্ডের সেরা চিকিৎসকরা বলেছিলেন “শ্যাম্পুইং” একটি সম্পূর্ণ অবৈধ ও অপ্রমানিত চিকিৎসা পদ্ধতি। কিন্তু ইংল্যান্ডের হাসপাতালগুলো তার কাছেই রোগীদের রেফার করতে শুরু করে। এর পরই হঠাৎ তিনি রাজা চতুর্থ জর্জ ও চতুর্থ উয়িলিয়াম এর “শ্যাম্পুইং” সার্জেন হিসাবে নিয়োগ পান। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। শ্যাম্পুইং ব্যবসায় রাতারাতি সাফল্যের মুখ দেখে তিনি ডা: ব্রাইটন নামে পরিচিতি লাভ করেন। ইংল্যান্ডের মানুষের কাছে টার্কিশ বাথ এর মতো বিখ্যাত হয়ে যায় ভারতীয় ম্যাসাজ বাথ ‘ শ্যাম্পুইং ‘ ।
এখানেই শেষ নয়, ইংরেজি ভাষায় প্রথম ভারতীয় বই লেখক হিসেবে দীন মুহাম্মদের নামে লিখেছেন ভারতীয় বিশেষজ্ঞ ইতিহাসবিদ মাইকেল এইচ ফিশার। ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতেন মুহাম্মদ। ১৭৯৪ সালে “দা ট্রাভেলস অফ দীন মুহাম্মদ” নামে তার বইটি প্রকাশিত হয়। এছাড়াও দীন মুহাম্মদ লিখেছিলেন “শ্যাম্পুইং” নিয়ে দুটো বই। ১৮২০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল “Cases Cured” এবং ১৮২৬ সালে প্রকাশিত হয় “Shampooing; or, benefits resulting from the use of Indian medicated vapor bath”! দেশে তিনি বিতর্কিত ও নিন্দিত হলেও ইউরোপে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন দীন মুহাম্মদ। ১৮৫১ সালে ইংল্যান্ডের সাসেস্কে ৯১ বছর বয়সে প্রয়াত হন তিনি। স্বদেশের নিন্দিত ও অপরিচিত হলেও ইউরোপ কিন্তু আজও ভোলেনি সফল এই বাঙালিকে। সম্প্রতি তার ২৬০তম জন্মদিনে ডুডলে সম্মান জানিয়েছে গুগল।