বাংলা প্রেমে হয়েছিলেন বাঙালী, এই ব্রিটিশ কর্তার হাত ধরে ২০০ বছর আগে ছাপা হয়েছিল প্রথম বাংলা বই
বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় তথা শ্রুতিমধুর ভাষার তালিকায় সর্বদাই উপরের দিকে রয়েছে বাংলা। এদিকে শাসন ভার সামলাতে এসে এই বাংলা প্রেমেই পড়েছিলেন একাধিক ব্রিটিশ কর্তা। এদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে বেশ কিছু মিশনারি কলকাতায় এসে ভিড় জমায়। ব্যাপারটা যে ব্রিটিশরা খুব একটা ভালভাবে নিয়েছিল তাও নয়। কারণ কোম্পানি তখনও এ দেশে ব্যবসা করতে চাইছিল। তাই ধর্ম প্রচার ঘিরে কোনও সমস্যা তৈরি হোক সেটা কোম্পানি চাইছিল না। ফলস্বরূপ ধর্মপ্রচারকরা অনেকেই চলে গেলেন হুগলীর শ্রীরামপুরে। সেই শহরটা তখন ডেনমার্ক সরকারের অধীনে। সে দেশের রাজা আবার ধর্মপ্রচারকদের সাহায্য করতে উৎসাহী ছিলেন।
সেই সময়েই ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসেছিলেন উইলিয়াম কেরি। জাহাজে চেপে ভারতে আসেন এই খ্রিষ্টান মিশনারি। অনেকেই মনে করেন মূলত খ্রিস্ট ধর্মের প্রসারের উদ্দেশ্যেই ১৭৯৩ সালে বাংলায় আসেন উইলিয়াম কেরি। কিন্তু দুর্বোধ্য ভাষায় ধর্মকথা মানুষের মনে দাগ কাটতে পারবে না, সেটা বুঝেছিলেন তিনি। তাই বাঙালিকে তার মাতৃভাষাতেই খ্রিস্টধর্মের মহিমা বোঝানোর কাজে লেগে পড়েন তিনি।
বাঙালিকে তার মাতৃভাষাতে খ্রিষ্টধর্মের পাঠ পড়াতে প্রথমে কেরিকে পুরোদমে বাংলা শিখতে হয়। তবে তার বাঁচার জন্য দরকার ছিল একটি কাজ। পেয়েও গেলেন সেই কাজ। এক মিলের কারখানায় ম্যানেজার হয়ে সপরিবারে চলে গেলেন মেদিনীপুরে। সেখানে কেরি ছ’বছর কাজ করেছেন তিনি, পাশাপাশি যথেষ্ট বাংলা শিখে ফেলেন। কেবল তাই নয়, “নিউ টেস্টামেন্ট” এর বাংলা অনুবাদও করে ফেলেন।
১৮০০ সালের জানুয়ারিতে শ্রীরামপুরে ঘাঁটি গড়লেন কেরি। সেখানে নবাগত মিশনারীদের মধ্যে তার সঙ্গী হোন ওয়ার্ড আর মার্শম্যান। নিরলস পরিশ্রমের জোরে বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে জায়গা করে নেয় এই “শ্রীরামপুর ত্রয়ী”। ১৮০০ সালের ১৩ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রীরামপুর মিশন। সে বছর মার্চে উইলিয়াম ওয়ার্ড এর নেতৃত্বে চালু হয় ছাপাখানা। শ্রীরামপুর মিশনের সেই ছাপাখানায় ছাপা হয় দু’খন্ড এর বাংলা বাইবেল। এর পরবর্তী ৩২ বছরে শ্রীরামপুরের ওই ছাপাখানা থেকে মোট ৪৫ টি ভাষায় ২ লক্ষ্য ১২ হাজার বই প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সময় হিসেবে যা এক দৃষ্টান্তমূলক এমনকী নজিরবিহীন ঘটনাও বটে।
তবে তিনি যে শুধু ধর্মের বই লিখেছিলেন তেমনটা নয়। তখনও বাংলায় বিদ্যাসাগরের জন্ম হয়নি। রামমোহনও কেরির থেকে বেশ ছোট। বাঙালিরা তখন বাংলা ভাষাতে কথা বলে, কিন্তু বাংলা গদ্য ভাষাটা একেবারেই আয়ত্তে ছিল না বলা যায়। ছাপাখানা এসে গেছে, কিন্তু চিঠিপত্র ছাড়া বাংলা সাহিত্য বলতে পুরনো কালের কবিতা। অথচ পৃথিবীর অন্যান্য অনেক ভাষাতেই গদ্য ভাষায় রচিত হচ্ছে গল্প-উপন্যাস। কিন্তু বাংলায় তা লেখার মতো কেউ নেই। উদ্যোগ নিলেন উইলিয়াম কেরি, শিখে ফেললেন সংস্কৃত, ওড়িয়া সহ একাধিক ভাষা। বাংলায় একটি বইও রচনা করে ছাপালেন নিজেরই ছাপাখানায়।
এদিকে ১৮১৮ সালে উয়িলিয়াম কেরির (William Carey) উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রীরামপুর কলেজ। অন্যদিকে সাহিত্যচর্চা হোক বা সাহিত্য সৃষ্টি, প্রতিক্ষেত্রে বাঙালির বিশ্বজোড়া খ্যাতি রয়েছে। এই বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টির ক্ষেত্রে উইলিয়াম কেরির অবদান কোনও অংশে কম নয়। কারণ বাঙালিকে গদ্য ভাষায় লিখতে শিখিয়ে ছিলেন তিনি। এমনকি শোনা যায়, বিদ্যাসাগরও বাঙালীদের শিক্ষার প্রসারে সাহায্য পেয়েছিলেন কেরির।