তুমি শশী হে! স্মৃতির কোলাজে ম্যানারিজম কিং

‘‘আজ মেরে পাস বিল্ডিং হ্যায়, প্রপার্টি হ্যায়, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স হ্যায়, বাংলা হ্যায়, গাড়ি হ্যায়— ক্যায়া হ্যায় তুমহারে পাস?’ বিজয়রূপী অমিতাভ বচ্চনের এই সংলাপকে টেক্কা দিয়ে শশী কাপুরের (Shashi Kapoor) ঠোঁটে অমর হয়ে আছে সেই উত্তর, ‘‘মেরে পাস মা হ্যায়’।
শশী কাপুর (Shashi Kapoor) মানেই ‘দিওয়ার’ ছবির সেই স্মরণীয় মুহূর্ত, যা কিনা গত চল্লিশ বছর ধরে আপামর ভারতবাসীকে কাঁদিয়েছে, আবেগে ভাসিয়েছে, আবেগতারিত করেছে। শশী কাপুর (Shashi Kapoor) মানে উদ্দাম যৌনতায় ভরা কনরাড রুকস-এর ‘সিদ্ধার্থ’। জিনাত আমন থাকলেও ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ মানে কিন্তু শশী কাপুরও।
পৃথ্বীরাজ কাপুরের তৃতীয় সন্তান ছিলেন তিনি। পর্দার নাম শশী কাপুর (Shashi Kapoor)। তবে আসল নাম তাঁর বলবীর রাজ কাপুর। আর এই কলকাতাতেই জন্ম তাঁর।বাড়িতেই ছিল কেবল অভিনয়, অভিনয় আর অভিনয়। তাই ছোটবেলা থেকেই অভিনয়ের জগতে প্রবেশ। প্রথমে থিয়েটার, পরে সিনেমায় আগমন। সংগ্রাম ছবিতে দাদা রাজ কাপুরের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করে বেশ নাম কামিয়েছিলেন। ১৯৬১ সালে ‘ধর্মপুত্র’ ছবিতে ফের তাঁর প্রত্যাবর্তন হয় নায়ক হিসেবে।
সিনেমার কেরিয়ার ‘শান্দার’ হলেও শশীর (Shashi Kapoor) আসল ভালবাসা ছিল থিয়েটার। এই থিয়েটারের সূত্রেই তাঁর জেনিফার কেন্ডলের সঙ্গে আলাপ। নাটকই দুই অভিনেতাকে কাছাকাছি নিয়ে আসে। শশী-জেনিফারের তিন সন্তান রয়েছে কুণাল কাপুর, করণ কাপুর, সঞ্জনা কাপুর।
প্রথাগত ধারার চেনা পথের বাইরে হাঁটা এক মানুষ মানে যেমন শশী কাপুর (Shashi Kapoor), তেমনি অন্য দিকে ভারতীয় চকোলেট বয় হিরোর প্রথম ইমেজটা যেন তিনিই স্থির করে দিয়েছিলেন। এক সময় কোনও অষ্টাদশীর বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা ছবির মুখ মানেই শশী কাপুর। কিন্তু সেই ইমেজকে বারবার টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে অন্য এক শশী কাপুরও। কখনও আর্মি অফিসার, কখনও পুলিশ ইন্সপেক্টরের চরিত্রে অভিনয় করে প্রমাণ করেছেন তাঁর দাপট। সেই অভিনয়ে পাওয়া যেত হলিউডি ঘরানার ছোঁয়া।
‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন’, ‘নিউ দিল্লি টাইমস’, পৃথ্বী থিয়েটার, জেনিফার কেন্ডাল এক দিকে তো অন্য দিকে শশী কাপুর মানে রোম্যান্সের মিষ্টি হাসি। মুখভঙ্গিতে দেখা দিত সততা, স্বচ্ছতার সারল্য। বিভ্রান্ত রাজনৈতিক আবহাওয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাঁর অভিনীত পুলিশ অফিসার চরিত্র মানুষের মনে জাগিয়ে তুলত প্রশাসনের প্রতি বিশ্বাস। ফলে সহজ বিশ্বাস আর ভালবাসা আদায় করে নিত শশী কাপুরের অভিনয়।
শশী কাপুর (Shashi Kapoor) ওরফে বলবীর রাজ কাপুরের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৮ মার্চ এই কলকাতা শহরেই। জন্মের এই বন্ধন যেন চিরকালের। এই শহরেই নাটক করার সুবাদে দেখা হয় ভাবী স্ত্রী জেনিফার কেন্ডালের সঙ্গে। সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে ছিল তাঁর দীর্ঘকালের আসা যাওয়া। এ প্রসঙ্গে পরিচালক সন্দীপ রায় বললেন, ‘‘আমাদের বাড়িতে সস্ত্রীক আসতেন শশী কাপুর। ‘চারুলতা’ যে বার ভেনিসে যায় সেই বছর ভেনিসে আমন্ত্রিত হয় শশী অভিনীত ‘শেক্সপিয়রওয়ালা’। ওখানে বাবার সঙ্গে শশীর খুব আড্ডা হত বলে শুনেছি। তা ছাড়া আমার পরিচালনায় ফেলুদা সিরিজে অভিনয় করেছিলেন শশীজি। ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’ করার সময় দেখেছি প্রচণ্ড পেশাদার অভিনেতা আর এক শশী কাপুরকে। যে ক’দিন শুটিং ছিল দারুণ মজা হয়েছিল এখনও মনে আছে।’’
শশী ক্যামেরার সামনে প্রথম আসেন শিশুশিল্পী হিসেবে। ‘আগ’ এবং ‘আওয়ারা’ ছবিতে তিনি রাজ কপূরের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। নায়ক হিসেবে তাঁর প্রথম আবির্ভাব ‘ধরমপুত্র’ ছবিতে ১৯৬১ সালে। দেশভাগের পটভূমিতে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে সেই ছবির গল্প। এই সাফল্যর পর শশী এগিয়ে যান বাণিজ্যিক ছবির সফলতার দিকে। অভিনয় করেন ‘যব যব ফুল খিলে’ তে। কেরিয়ারের প্রথম বাণিজ্যিক ছবিতে তাঁর নায়িকা ছিলেন নন্দা। নন্দার সঙ্গে আটটি ছবিতে অভিনয় করেন শশী। তাঁর আর নন্দার অন স্ক্রিন রেমিস্ট্রি তখন তুঙ্গে। শশী প্রায়ই নন্দার অভিনয়ের প্রশংসা করতেন।
আভিজাত্য আর বনেদিয়ানায় শশী বরাবরই তাঁর সমসাময়িক অভিনেতা ও কপূর খানদানের আর সব সদস্যদের থেকে আলাদা। সেই কারণেই তাঁর দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পাওয়া নিয়ে গোটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আজ উচ্ছ্বসিত। শুধু অভিনেতা হিসেবেই নয়, প্রযোজনার কাজে তাঁর প্যাশন ধরা পড়ে প্রতিটা স্তরে। ব্যতিক্রমী ভাবনাচিন্তা ছিল বলেই ‘জুনুন’ কিংবা ‘উৎসব’য়ের মতো ছবি প্রযোজনা করেছেন। ভিন্ন চিন্তাধারার মানুষ বলেই ভারতীয় সিনেমার সর্বোচ্চ সম্মানের পালক আজ তাঁর মুকুটে।
কপূর পরিবারের প্রথিতযশা তিন ভাইয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ শশী হিন্দি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নিজগুণেই আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁদের বাবা পৃথ্বীরাজ কাপুরও ছিলেন ভারতীয় সিনেমা ও থিয়েটারের এক কিংবদন্তি। থিয়েটার আর সিনেমা কাপুর পরিবারের রক্তে, মজ্জায়। সেই ঐতিহ্যকেই বয়ে নিয়ে গিয়েছেন শশী কাপুর।
ছবি পরিচালনাও করেছেন শশী। বেশ কড়া ধাতের পরিচালক ছিলেন তিনি। এ কথা স্বীকার করেছে স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন। অজুবা ছবির শুটিং চলাকালীন নাকি পরিচালক শশী সেটে ছড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। ভুল হলেই নিস্তার ছিল না। তবে সেটে কারও অসুবিধা হলে সবার আগে তা মেটাতে ছুটতেন তিনিই।
অপর্ণা সেনের সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল তাঁর। সিনেমার সূত্রেই দু’জনের আলাপ হয়। ‘৩৬ চৌরঙ্গি লেন’-এর জন্য যখন হন্যে হয়ে প্রযোজক খুঁজছেন অপর্ণা, তখন ত্রাতা হন শশীই। চিত্রনাট্য পড়েই ছবি প্রযোজনা করতে রাজি হয়ে যান তিনি। ছবিতে অভিনয় করেছেন তাঁর স্ত্রী জেনিফারও।
আটানব্বইয়ের পর সিনেমার জগতকে বিদায় জানান। কিন্তু অভিনয় প্যাশন শেষ দিন পর্যন্ত এতটুকু কমেনি। কুণাল জানান, যখনই তাঁদের মধ্যে কথা হত বেশিরভাগই অভিনয়ের কথাই হত। অভিনয় ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-প্রাণ। প্রাণের এই স্পন্দন ভবিষ্যতের জন্য রেখেই স্মৃতির সরণিতে চিরতরে আশ্রয় নিলেন শশী।
আরও পড়ুন আসল পুতিন-নকল পুতিন, সার্জারি করে চেহারা বদল ভ্লাদিমিরের
আরও পড়ুন বিশ্বকাপে হার ঝুলন-মিতালিদের, তবু সেমির টিকিট পেতে লড়বে মেয়েরা