খাঁড়া নেমেছে মহিলা সাংবাদিকদের উপর, প্রাণভয়ে সহকর্মীরা! কীভাবে লড়ছে আফগানিস্তানের এই বিখ্যাত সংবাদমাধ্যম?
ওয়েব ডেস্ক: দীর্ঘ দুদশক পর আফগানিস্তানের ক্ষমতার শীর্ষে ফিরেছে তালিবান। প্রত্যাবর্তনের পর গোটা আফগানিস্তান জুড়ে এখন ত্রাহি ত্রাহি রব। এরমধ্যেই একাধিক ফতোয়া জারি করে দেশে ফিরেছে মধ্যযুগীও শরিয়ত আইন। কোপ পড়েছে ছোট বড় সব মিডিয়া হাউসের উপরেই। তালিবানের ভয়ে পাততারি গুটিয়ে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন বহু সংবাদিক। কিন্তু তালিবানের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে, তাদের সামনে নিজেদের মাথা না ঝুঁকিয়ে কর্তব্যের প্রতি অবিচল ও নির্ভীক থেকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে আফগানিস্তানের স্বনামধন্য সংবাদমাধ্যম টোলো নিউজ। ‘যাই যদি যাক প্রাণ’ তবুও তালিবানের সামনে শিরদাঁড়া না ঝুঁকিয়ে খবর পরিবেশন করার হুঁশিয়ার দিয়েছেন টোলো নিউজের পরিচালন সংস্থা মবি গ্রুপের চিফ এক্সিকিউটিভ সাদ মোহসেনি।
কিন্তু কে , এই সাদ মোহসেনি ?
১৯৬৬ সালের ২৩ এপ্রিল, লন্ডনে জন্ম সাদের। বাবা ইয়াসিন মোহসেনি ছিলেন আফগান কূটনীতিক , এবং মা ছিলেন বিবিসির নিউজ প্রেসেন্টের। কাবুল, টোকিও, ইসলামাবাদে বেড়ে ওঠা সাদের। তারপর অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে এক ব্যাঙ্কিং কোম্পানির ইকুইটি ও কর্পোরেট ফিনান্স বিভাগে কাজ শুরু করেন সাদ। কিন্তু ২০০০ সালে, সব ফেলে ফিরে আসেন নিজের দেশে। আফগানিস্তানে সংবাদমাধ্যমের দুরাবস্থা দেখে ঠিক করেন তা পাল্টে ফেলার।
যুদ্ধ বিধস্ত আফগানিস্তানের মিডিয়ার দুরাবস্থা একা হাতে পাল্টেছেন মোহসেনি। প্রসঙ্গসূত্রে বলে রাখা ভালো, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ অবধি, প্রথম তালিবানি শাসনে সাংবাদিকতার দখল ছিল তাদের হাতেই। তালিবান সমর্থিত মিডিয়া হাউস ছাড়া অন্য সব মিডিয়া হাউস নিষিদ্ধ ছিল। তা ছাড়াও শরিয়ত আইন অনুযায়ী সিনেমা, টিভি এবং অন্যান্য যে কোনো ধরনের বিনোদনমূলক শিল্প হারাম হওয়ার দরুন সেসবের উপর জারি করা ছিল নিষেধাজ্ঞা।
২০০৩ সালে সাদ মোহসেনি নিজের যাত্রা শুরু করেন রেডিওর হাত ধরে। আফগানিস্তানের প্রথম প্রাইভেট রেডিও স্টেশন আরমান এফএম-এর কর্ণাধার ছিলেন তিনি, যেখানে আফগান আর হলিউড গান চালানো হতো ,যা ছিল তালিবানি শাসনকালে হারাম। তারপরের বছর, অর্থাৎ ২০০৪ সালে নিজের ব্যবসা ইথিপিওয়া, উত্তর সাহারা, ইরান এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে। আফগানিস্তানের প্রথম বিনোদনমূলক টিভি চ্যানেল হিসেবে উঠে আসে টোলো টিভি। ব্যবসার বৃদ্ধি বাড়তে থাকে মোহসেনির। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউএস এইডের ফান্ডিং পেতে শুরু করে মোবি গ্রুপ। এরপর ফক্সের শেয়ার কেনার পর, আফগানিস্তানের ‘রুপার্ট মার্ডক ‘ নামেও ডাকা শুরু হয়ে মোহসেনি কে।
এরপর ২০১০ সালে টোলো নিউজ লঞ্চ হওয়ার বাড়তে থাকে সমস্যা। তালিবান বিরোধী মনোভাবাপন্ন হওয়ার দরুন বারবার তালিবানের সঙ্গে সংঘর্ষের মুখে পড়তে হয় সাংবাদিকদের। মহিলা সাংবাদিকদের খুন এবং ধর্ষণের হুমকির মুখে পড়তে হয়। তবুও সব প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলে টোলো নিউজ। তালিবানদের চোখ রাঙানিকে ভয় না পেয়েই এগিয়ে গিয়েছে তারা। যে দেশে নারীস্বাধীনতা এবং নারীদের মৌলিক মানবাধিকার শুধু একটি অক্সিমোরন, সেখানে দাঁড়িয়ে তারা সুযোগ দিয়েছে মহিলা সাংবাদিকদের। এক অচেনা আফগানিস্তান, এবং সেদেশের দুরবস্থার কথা তুলে ধরেছে বাকি পৃথিবীর সামনে।
গত ১৫ অগাস্ট, কাবুলের পতনের পর, তালিবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ আস্বস্ত করেছিলেন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার অক্ষুন্ন রাখার। তবে, বাস্তবে তা রাখা হয়নি। ইতিমধ্যেই প্রাণহানির আশংকায় দেশ ছেড়ে পালতে বাধ্য হয়েছেন বহু সাংবাদিক। বহু নিউজ চ্যানেল এবং রেডিও স্টেশন নিজেদের সম্প্রসারণ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। টোলো নিউজ সহ আরো অনেক মিডিয়া হাউজে ইতিমধ্যে হানা দিয়েছে তালিবান বাহিনী।
সম্প্রতি, ‘কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস’ কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মোহসেনি জানিয়েছেন যে উনি ভীত এবং নিজের স্টাফেদের জীবননাশের আশঙ্কায় তটস্থ। তবুও, নিজের প্রাণের চিন্তা না করেই সংবাদ পরিবেশন করতে চান তিনি।
মধ্যযুগীয় বর্বরতার এক নতুন নির্দশন হল তালিবানের আফগানিস্তান জয়। গণতন্ত্রের ৪টি স্তম্ভই গুড়িয়ে দিয়ে এখন সেই দেশে চলছে নৈরাজ্য। কি হতে চলেছে আফগানিস্তানের পরিণতি, তা সময় বলবে।