চোখে স্বপ্ন, পায়ে তড়িৎগতি! রেসিং ট্র্যাককে অবলম্বন করে সমাজের মুলস্রোতে ফেরার লড়াইয়ে কর্ণাটকের সিদ্দিরা
ভোর। ধূ ধূ করছে মাঠ। সূর্যকিরণ মাঠের ঘাসে পড়ার সঙ্গেই মাঠে পা পড়ে রবিকিরণ ফ্রান্সিস সিদ্দির। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাঠের চারপাশে চক্কর দিয়ে এসে হাঁপাতে থাকে সিদ্দি। দূরে তখনও দাঁড়িয়ে ফ্রান্সিসের বন্ধুরা। তাদের কৌতূহলী চোখে প্রশ্ন একটাই, ‘এত সকালে ফ্রান্সিস কী করছে এখানে?’
একদিন স্কুলের শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক শরীরচর্চার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করেছিলেন বিশদে। সেই শুরু, সকালে উঠে শরীরচর্চা এখন রবিকিরণের প্রত্যহের অভ্যাস। কর্ণাটকের উত্তর কন্নড় জেলার মান্ডগডের রবিকিরণ লয়োলা হাইস্কুলের ছাত্র। লয়োলা হাইস্কুলের তরফে জানান হয়েছে, “এক কাবাডি খেলোয়াড়ের খোঁজ করার সময়ে রবির উপর চোখ পড়ে শিক্ষকদের। ওর দৌড়ানোর ক্ষমতা অসাধারণ। ঘষামাজা করলে রবি চমকে দিতে পারে অনেককেই।” বর্তমানে পড়াশোনার পাশাপাশি সমানতালে চলছে রবির ক্রীড়াসাধনা।
মাত্র ২ বছরের প্রশিক্ষণেই হরিণের গতি রবির পায়ে! ১০০ মিটার দৌড়াতে এখন রবি সময় নেয় ১১ সেকেন্ড, যা জাতীয় রেকর্ডের থেকে মাত্র ০.৭ সেকেন্ড কম! “মাঠে আমি যাই বা না যাই, ও প্র্যাকটিসে থাকবেই। ওর অধ্যবসা ও সাধনা ওকে ওর লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে নিশ্চয়ই”, জানালেন রবির স্কুলের শরীরচর্চার শিক্ষক নীতিশ চিনিওয়ার। “ভবিষ্যতে আরও শিখতে চাই ও আন্তর্জাতিক স্তরে পদক জিততে চাই”, আত্মবিশ্বাসের সুর রবির গলায়। ঐতিহাসিকদের মতে, রবির মতো আরও অনেকে আছেন যাঁরা সিদ্দি জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ভারতে প্রায় ৫ শতক ধরে কোণঠাসা হয়ে পড়ে থাকা সিদ্দিরা আদতে আসে পর্তুগিজদের ক্রীতদাস হিসেবে।
নৃতাত্বিক মার্ক পিন্টোর মতে, “আফ্রিকায় পর্তুগিজ উপনিবেশ বলতে তখন মোজাম্বিক। এই মোজাম্বিক থেকেই সিদ্দিদের ভারতে আনা হয় চাকরবাকর হিসেবে।” ১৮৬৯ সাল নাগাদ পর্তুগিজ কলোনীতে ক্রীতদাস রাখার প্রথা বাতিলের পর থেকেই কর্ণাটক, গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের অরণ্যে সরে যায় সিদ্দিরা। সূত্রের খবর, উত্তর কন্নড়ের ইয়াল্লাপুরমান্ডগড ও হলিয়ালে প্রায় ৪০,০০০ সিদ্দির বাস। বছরের পর বছর ধরে কুলির কাজ করে এসেছেন এনারা। বর্ণভেদ ও জাতপাতের তুল্যমূল্য বিচারে প্রাপ্য সম্মানটুকুও পাননি সিদ্দিরা।
পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের সমাজের মুলস্রোতে ফেরাতে ১৯৮৭ সালে ভারতের ক্রীড়া পর্ষদ (SAI) নতুন প্রয়াস শুরু করে। যদিও সঠিক কৌশল ও পরিকাঠামোর অভাবে মাত্র ৬ বছর পরই বন্ধ হয়ে যায় ‘স্পেশাল এরিয়া গেম স্কিম’। প্রকল্পের আওতায় যে ৬৫ জনকে বেঙ্গালুরুতে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দেয় কেন্দ্রীয় ক্রীড়া বিভাগ, তাঁদের ভবিষ্যৎও অন্ধকারে চলে যায়।
২০০৯ ও ২০১৬ সালে পুনরুজ্জীবিত করা হয় এই প্রকল্পকে। যদিও পুনরায় ব্যর্থ হয় ক্রীড়া বিভাগ। লয়োলা হাইস্কুলের আর এক ক্রীড়াশিক্ষক ভীরানাগৌড়া মাল্লানাগৌড়ার মতে, “কেন্দ্র প্রকল্প চালু করে, কিন্তু সঠিক প্রশিক্ষক পাঠায় না। ফলে নামেই শুরু হয় প্রশিক্ষণ। সঠিক শিখন পদ্ধতির অভাবে অধরা থেকে যায় ক্রীড়াবিদ তৈরির কাজ।”
সিদ্দি জনগোষ্ঠীরআর এক উঠতি প্রতিভা বছর সতেরোর শোয়েতা সিদ্দি। শোয়েতার মতে, “আমাদের এখানে নারী প্রশিক্ষক নেই। ফলে অনেকেই প্রশিক্ষণ নিতে পারে না। আর তাই আমি দ্বাদশ শ্রেণী উত্তীর্ণ হয়ে প্রশিক্ষক হিসেবে স্কুলে যোগ দিতে চাই।” শুধু প্রশিক্ষক নয়, একজন সফল ক্রীড়াবিদ হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে শোয়েতার মধ্যে।
টিভি বা ইউটিউবে উসেইন বোল্টের দৌড় দেখতে ভাল লাগে শোয়েতা-রবিদের। একদিকে যখন বর্ণের জন্য কোণঠাসা এই উঠতি প্রতিভারা, তখন অন্যদিকে জামাইকার দৌড়বিদকে দেখে উত্তেজনায় টগবগিয়ে ফুটতে থাকে তরুণ হৃদয়। কে বলতে পারে, হয়তো রবি কিরণ বা শোয়েতারাই একদিন ভেঙে ফেলবে বিশ্বরেকর্ড!