রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরের থেকে যাদবপুর কবে শিখবে?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের একাংশের নষ্টামির বিরুদ্ধে সরব সমাজ। সোশ্যাল মিডিয়া, টিভি চ্যানেলে বিতর্ক চলছে। উঠে আসছে হাড় হিম করা সব তথ্য।

কৌশিক, কলকাতা: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বললে কী মনে আসে? অতিবাম চিন্তাধারা, স্লোগান, বিক্ষোভ, আন্দোলন। সঙ্গে নেশা, অবাধ যৌনতা। এবং অবশ্যই র্যাগিং, সিনিয়র দাদাদের ‘দাদাগিরি’। পড়াশোনা যেন গৌন, এগুলোই মুখ্য। রসিকজন অবশ্য বলতে পারেন, ‘আগে চান্স পেয়ে দ্যাখা’।
প্রথম বর্ষের পড়ুয়ার অকালমৃত্যুর পর এসব কথাই ঘুরছে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের একাংশের নষ্টামির বিরুদ্ধে সরব সমাজ। সোশ্যাল মিডিয়া, টিভি চ্যানেলে বিতর্ক চলছে। উঠে আসছে হাড় হিম করা সব তথ্য।
র্যাগিং নাকি যাদবপুরের ‘ঐতিহ্য’। জুনিয়র ছাত্রদের সরু রেলিং ধরে হাঁটানো, নগ্ন করে ঘোরানো, গোপনাঙ্গের ইতিহাস ব্যাখ্যা, মা-বাবাকে নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য, হারানো জিনিস চাইতে গেলে মদ খেতে বলা – এসব নাকি সিনিয়ররা করেই থাকে।
এর উপর আছে রাজনীতি। অতিবাম রাজনীতি। তাদের কাছে রাষ্ট্র হল শোষণের যন্ত্র। যে দেশের মাটিতে জন্ম হয়েছে, যে দেশ বেড়ে ওঠার সুযোগ দিয়েছে, সেই দেশ খারাপ। সরকার আরও খারাপ। বড় বড় শিল্পপতিরা খারাপ, তারা পুঁজিপতি। ভালো কারা? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও নাকি সবই জানে। কিন্তু তাদের কত কাজ! এসব ছোটখাটো বিষয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় কোথায়!
সংস্কৃতে একটি শ্লোক আছে, ‘বিদ্যা দদাতি বিনয়ং’। বিদ্যা বিনয় দান করে। মর্মার্থ হল, বিদ্যালাভে ছাত্র বিনয়ী হয়। নানা সময়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভাইরাল ভিডিও দেখলে মনে হবে, ভুল করে বোধহয় এই শ্লোক লেখা হয়েছে।
কিন্তু না। ভুল নয়। এই শ্লোক অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। এই রাজ্যেই এমন কলেজ আছে। রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির। বেলুড় মঠের ঠিক পাশেই। স্কুল, কলেজ যে বিদ্যার মন্দির, এই কথাটা এখানে এলে বোঝা যায়। এখানে সিনিয়র, জুনিয়র নেই। দাদা-ভাই আছে। হ্যাঁ, জুনিয়ররা ভাই, সিনিয়ররা দাদা। দাদারা ‘দাদাগিরি’ দেখায় না, ভাতৃস্নেহে জুনিয়রদের আগলে রাখে।
রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির আবাসিক। যাদবপুরের মতোই। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নবীন বরণ নয়, এখানে ‘ভাতৃবরণ’ হয়। ‘ইন্ট্রো’ দিতে হয় না। প্রথম বর্ষের এক পড়ুয়া বলছিলেন, ‘প্রথমদিন দাদারা ভ্যানে করে আমাদের ব্যাগপত্তর হস্টেলে পৌঁছে দেয়। বুঝিয়ে দেয় সবকিছু। আমাদের জন্য দাদাদের ঘরের দরজা সবসময় খোলা’।
সন্ধ্যে হলেই মদ, গাঁজার আসরের কথা বিদ্যামন্দিরের ছাত্ররা ভাবতেও পারে না। কেউ লাইব্রেরি যায়, কেউ শরীরচর্চায় মগ্ন থাকে। তাছাড়া পড়াশোনাও তো আছে। বিদ্যামন্দিরের অধ্যক্ষ স্বামী প্রজ্ঞানন্দ মহারাজ বলেন, ‘প্রথম দু-একদিন মহারাজদের তত্ত্বাবধানে সিনিয়ররা জুনিয়রদের সাহায্য করে। কয়েক দিনের মধ্যে ওঁরাও এখানকার ছেলে হয়ে যায়’।
অন্তিম বর্ষের এক ছাত্র বিদ্যামন্দিরের করিডোরে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, ‘এটা আমার শেষ বছর। খুব মন খারাপ। এরকম কলেজ, হস্টেল কোথাও পাব না। এই পরিবেশ টাকা দিয়েও কেনা যায় না। হ্যাঁ, বাড়িতেও এমন জিনিস দেখিনি’। কথাগুলো বলার সময় তাঁর চোখেমুখে অন্য আভা। হ্যাঁ, দুষ্টুমি কি হয় না, হয়। কিন্তু সেটা নিছকই দুষ্টুমি, অপরাধ নয়। সীমা ছাড়ায় না কখনওই।
এখন প্রশ্ন হল, রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দিরের থেকে যাদবপুর কবে শিখবে?