৭ বছর আগে ছাত্র আন্দোলনের নতুন সংজ্ঞা এঁকেছিল যাদবপুর, ফিরে দেখা কলরবের দিনগুলি
স্বাধীনতার পর থেকেই শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতির আঙিনায় বরাবরই অন্যান্য রাজ্যেকে টেক্কা দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে ছাত্র-আন্দোলন আরও জোড়ালো হয় ষাটের দশকের শেষ পর্ব থেকে। নতুন করে জোয়ার আসে ২০০০ সালের পরেই। এদিকে বিগত ২০ বছরে কলকাতা থেকে রাজ্য সহ গোটা দেশেই ছাত্র আন্দোলনে একাধিক নতুন নজির গড়ে দিয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। আর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সংগ্রামী ইতিহাসেই স্বার্ণক্ষরে লেখা রয়েছে ২০১৪ সালের সাড়া জাগানো হোক কলরব আন্দোলন।
অন্যদিকে ২০১১ সালে বাংলায় সিপিএমী শাসনের পতনের পর থেকে ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে প্রথাগত ছাত্র রাজনীতির চরিত্র। জন্ম হয় একাধিক নতুন ধারার ছাত্র আন্দোলনের। পুনঃজাগরণ দেখা যায় নকশাল পন্থী ছাত্র সংগঠনগুলিরও। মাথাচাড়া দেয় স্বাধীন ছাত্র সংগঠন গুলিও। প্রথাগত বামের বদলে ছাত্রদের সংসদীয় নীতিগত এবং আদর্শগত অবস্থান থেকে তৈরি হয় একাধিক নতুন ধারার ছাত্র আন্দোলন। আর সেই রাস্তাতে হেঁটেই নতুন মাইল স্টোন তৈরি করে হোক কলরব। ২০১৪-র সেই দুনিয়া কাঁপানো আন্দোলনের সপ্তম বর্ষপূর্তিতেই এবার ফের ‘কলরবী’ স্লোগানে ছেয়ে যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়াল। যাদবপুর তো বটেই হিন্দোল উঠেছে গোটা ছাত্র সমাজেই।
২০১৪ সালের ২৮ অগাস্ট যাদবপুরের এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ শোনা যায়। ছাত্রীর বাবা অভিযোগ জানান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। অভিযোগ ফিরিয়ে দেন উপাচার্য। আর তাতেই জ্বলে ওঠে আগুন। শুরু হয় আন্দোলন। ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেন শিক্ষামন্ত্রী। তদন্ত শুরু করে বিশ্ব বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আইসিসি কমিটি। কিন্তু তারপর বেশ কয়েকদিন কেটে গেলেও তদন্ত ঠিক পথে এগোচ্ছে না বলে দাবি করে পড়ুয়ারা। শুরু হয় জোরদার অবস্থান বিক্ষোভ।এরপর ১৬ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসির মিটিংয়ে বিক্ষোভ দেখায় পড়ুয়ারা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই চড়তে থাকে আন্দোলনের পারদ। আর ওই দিনই ঘটে সবথেকে নক্কারজনক ঘটনা। রাত পৌনে ৯টা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকে পুলিস। গভীর রাতে পড়ুয়াদের ওপর নির্বিচারে চলে লাঠিচার্জ। জখম হন অনেকে।
এই ঘটনার পরেই নতুন উদ্যোমে গর্জে ওঠে যাদবপুর। ২০ সেপ্টেম্বর বিশাল ছাত্র সমাবেশের ডাক দেওয়া হয় একাধিক ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে। আন্দোলনের এক নতুন রূপ দেখে বৃষ্টিভেজা তিলোতমা। মেয়ো রোড থেকে রাজভবন আন্দোলিত হলো হোক কলরবে। মিছিল থেকে উঠল উপাচার্য অভিজিত চক্রবর্তীর অপসারণের জোরালো দাবি। শুরু হল ক্লাস বয়কট। এরপর টানা তিন মাসের বেশি সময় ধরে চলতে থাকে আন্দোলন। উপাচার্যের অপসারণের দাবিকে সামনে রেখে হয় গণভোট। ইঞ্জিনিয়ারিং, কলা বিভাগে ৯৭ শতাংশ পড়ুয়া ভোট দেন উপাচার্যের বিরুদ্ধে। যদিও তারপরেও পদ আকড়ে পড়ে ছিলেন উপাচার্য। এদিকে গণভোটের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিতে দেখা যায় রাজ্যপালকে।
এদিকে প্রতি বছর ২৪ ডিসেম্বরেই সমাবর্তন অনুষ্ঠান হয়ে থাকে যাদবপুরে। সেখানেও পৌঁছাল আন্দোলনের আঁচ। ২৪ ডিসেম্বর সমাবর্তন বয়কট করলেন আন্দোলনকারী পড়ুয়ারা। যার রেশ ছুঁয় গিয়েছিল ২০১৯ সালের সিএএ-এনআরসি আন্দোলন পর্যন্তও। বিজেপি-র নয়া নীতির বিরোধীতা করে সেই বছরও সমাবর্তন বয়কট করেন একটা বড় অংশের পড়ুয়া। এদিকে ২০১৪ সালে আগুনে আন্দোলনের মাঝেই সমাবর্তন মঞ্চ থেকে শংসাপত্র ফিরিয়ে দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা স্নাতক গীতশ্রী সরকার। ফিরিয়েছিলেন আরও অনেক পড়ুয়াই। যার জেরে বড় অস্বস্তিতে পড়ে সরকার।
এর পর ঘুরে গিয়েছে ক্যালেন্ডারের পাতা। উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় আন্দোলনরত পড়ুয়াদের আমরণ অনশন। আরও চাপে পড়ে সরকার। অবশেষে ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন মুখ্যমন্ত্রী। ঘোষণা করলে আর উপাচার্যের পদে আর থাকছেন না অভিজিত চক্রবর্তী। শাসকের চোখে চোখ রেখেই হোক কলরবের দীপ্ত স্লোগানে এইভাবেই জয় ছিনিয়ে আনে যাদবপুর।