কালের নিয়মে ধুয়েছে বর্বরতার ক্ষত!ব্রিটিশ আমলে কলকাতার এই ব্যস্ত রাস্তাতে দেওয়া হত ফাঁসি
কিছুদিন আগে ধর্মতলা থেকে রাজভবন হয়ে অফিসপাড়ার দিকে একটা বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছিলাম। ঠিকানাটা জানার জন্যে একটা চায়ের দোকান দেখে থামলাম। দোকানের সামনে বসে থাকা একজন বৃদ্ধ বললেন, এই ফ্যান্সি লেন ধরে হেঁটে বাদিকের গলিতে। “ফ্যান্সি লেন?”
তিলত্তমার এই পান্নালাল রোডে বহুবার এসেছি, কিন্তু এই নামটি কখনো শুনিনি। তাই একটু চমকেই গেলাম; আর ইতিহাসের পাতা উল্টাতেই এই চমক আরও তীব্র হল। ধরুন, টাইম মেশিনে চেপে আপনি এসে পৌঁছালেন পৌঁছালেন ব্রিটিশ শাসিত কলকাতায়। আপনার চেনার মধ্যে তখন শুধু ধর্মতলা। বাকি জায়গা তখন শুধু জঙ্গল আর নির্জন রাজপথ। কলকাতার ওয়েলেসলি প্লেস থেকে কাউন্সিল হাউজ পর্যন্ত রাস্তাটিকেই তখন বলা হত ‘ফ্যান্সি লেন’। এই ‘ফ্যান্সি’ শব্দটি ইংরেজদের কোন শৌখিনতার পরিচয় নয়, বরং তাকে বর্বরতা বললেও কম বলা হয়। ‘ফ্যান্সি’ কথাটা এসেছে ‘ফাঁসি’ শব্দ থেকে। ইংরেজরা ‘ফাঁসি’ উচ্চারন করতে না পেড়ে ‘ফ্যান্সি’ উচ্চারন করতেন। প্রকাশ্য দিবালোকে ভরা রাস্তায় জনসাধারনের চোখের সামনে ইংরেজ শাসকেরা আমাদেরই আপনজনদের ‘ফাঁসি’ দিয়ে তৈরি করতেন বর্বর ‘দৃষ্টান্ত’।
ইতিহাসিক আর্চডিকন হাইড তাঁর দুটি বই ‘প্যারোকিয়াল অ্যানালস’ এবং ‘পেরিশ অব বেঙ্গল’-এ লিখেছেন, কলকাতার অন্যতম পুরোনো রাস্তা এটি। একটা সময় এর পাশ দিয়ে বয়ে যেত একটা খাল বা ‘ক্রিক’।— “The creek took a half turn round this battery and kept Eastwards beneath three gated bridges, until the fences turned downwards from it at Fancy Lane.” এখন অবশ্য সেটি মুছে গেছে। ডালহৌসির কাছে এখন যেখানে কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট, ইংরেজ আমলে এখানেই ছিল লালদিঘির প্রায় গা-ঘেঁষা সাহেবপাড়া। কলকাতায় তখন জব চার্নকের নতুন রাজত্ব। অপরাধ যাই থাকুক না কেন গরিব লোকদের ফাঁসি দেওয়াই তখন সাহেবদের শৌখিনতা।
ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া যায়, ২৫ টাকার একটি ঘড়ি চুরির অপরাধে ব্রজমোহনকে প্রকাশ্য রাস্তায় ফাসি দেওয়া হয়। ঢেঁড়া পিটিয়ে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয় সাধারণ মানুষকে। আর তদানন্তীন ‘ক্যালকাটাবাসীরা’ পিলপিল করে জমা হয় সেখানে। এখান থেকেই শুরু হয় প্রকাশ্য দিবালোকে ফাঁসির পর্ব। আর তারপর ছোট ছোট অপরাধেও গলায় পড়ত ফাঁসির ফাঁস। রাস্তার ধার ঘেঁষে সার দিয়ে ঝুলে থাকত মৃতদেহ। ফাঁসি দেওয়া ওই রাস্তাটির নামই পরবর্তীকালে ইংরেজদের মুখে মুখে হয়ে যায় ‘ফ্যান্সি লেন’ যা বর্তমানে পান্নালাল রোড। পুরনো কলকাতা নিয়ে একটি লেখায় শ্রীপান্থ বলছেন, এই রাস্তাতেই মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি দেখে সবাই ফিরেছিলেন গঙ্গাস্নান করে। কারণ নন্দকুমার ছিলেন ব্রাহ্মণ। আর ব্রহ্মহত্যা দেখার মহাপাপ ধুয়ে ফেলার সামাজিক বিধানই ছিল গঙ্গাস্নান।
ইতিহাসিক এই ফ্যান্সিলেনে এখন রয়েছে রাজভবনের স্টাফ কোয়ার্টার্স, কিছু অফিস ও দু’একটি ছোট দোকান। সঙ্গে ব্রিটিশ আমলের ভেঙে-পড়া পুরোনো বাড়ি। কলকাতা শহরের গায়ে যে এরকম কত ইতিহাস লেগে আছে, তা বলাটা সত্যিই মুশকিল। আর তার থেকেও মুশকিল বলা, এই ইতিহাসের কতটাই বা আমরা জানি। আমার- আপনার শহর কোলকাতার সেইসব ইতিহাসের কথা জানলে, অপুর্নতা আর তৃপ্তির অনুভুতি দুইই একইসাথে ঘিরে ধরে। এখন প্রশ্ন, উন্নয়নের জোয়ারে আধুনিক কলকাতার অলিগলি আর কতদিন এই ইতিহাস নিয়ে বেচে থাকতে পারবে?