Barun Biswas: কালো মেঘের বাংলায় আকাশপাখি বরুণ, তেইশের দরজায় আজও কতটা প্রাসঙ্গিক ‛মাস্টারদা’

জয়িতা চৌধুরি,কলকাতাঃ সময়টা ২০১২ সালের ৫ই জুলাই। রোজকার মতনই ভিড়ে ঠাসা বনগাঁ লোকালে চেপে বাড়ি ফিরছেন তরুন প্রতিবাদী শিক্ষক। সারাদিনের ক্লান্তি চেহারায় ছাপ ফেললেও চোখ দুটি সপ্রতিভ ছিল তাঁর। বর্ষার সন্ধ্যে। তার উপর আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। স্টেশন চত্বর একেবারে নির্জন-নিঝুম। ট্রেন থেমেছিল তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে। সেখা ন থেকে সোজা এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন সেই তরুণ। স্টেশনের বাইরের গুমটি থেকে বাইকটি নিয়ে বাড়ি ফেরার কথা। কিন্তু সবকিছু ওলট-পালট করে দিল একটা বীভৎস শব্দ। বিনা মেঘে বজ্রাপাতের মতোই, গুলি এসে বুকে বিঁধে ছিল বছর আটত্রিশের যুবকটির।
বরুন বিশ্বাস। রাজনৈতিক ডামাডোলের বাজারে তরুন প্রতিবাদী মাস্টারমশাইকে নিয়ে আর বিশেষ কথা বলে না কেউ। একসময়ে পশ্চিমবঙ্গ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাশ করেও মানবসেবার জন্য শিক্ষকতার পন্থাকেই বেঁচে নিয়েছিলেন তিনি। ছাত্র জীবন থেকেই এলাকার প্রতিবাদী মুখ হিসেবে পরিচিত বরুণ বিশ্বাস। মুখ বুজে সমস্ত অন্যায় মেনে নেওয়ার এই যুগে স্রোতের বিপরীতে হাঁটতেন বরুণ। শুধু প্রতিবাদ নয়, অজুহাত দিয়ে যখন এ সমাজ পাশ কাটায় মানবিক দায়িত্ব থেকে তখন বারবার নিজের কাঁধে সব দায়ভার তুলে নিতেন অনায়াসে।
তৎকালীন গাইঘাটার সুঁটিয়া ছিল এক কুখ্যাত অঞ্চল, এই গ্রামকে বলা হত ‘ধর্ষণ গ্রাম’। তাঁদের অত্যাচারের সেই নারকীয় রূপ মধ্যযুগীয় বর্বরতা এবং বৃটিশ অত্যাচারকেও ছাপিয়ে যায়। চব্বিশ পরগণা জেলার সুঁটিয়া ও তার আশপাশের গ্রামগুলোতে সেসময় তাণ্ডব চালাত এক দল মানুষরূপী পিশাচ। কুখ্যাত সুশান্ত চৌধুরী ও বীরেশ্বর ঢালীর নেতৃত্বে বেশ কয়েক বছর ধরে দাপিয়ে বেড়াত কুড়ি পঁচিশজনের একটি সমাজবিরোধী দল। খুন জখম, তোলা আদায়, জোরজুলুম তো ছিলই, তার পাশাপাশি শুরু হয়েছিল ব্যাপকভাবে নারী নির্যাতন আর ধর্ষণ। সুঁটিয়া অঞ্চলকে কার্যত নরকে পরিণত করে রাজনৈতিক মদতপুষ্ট এই সমাজবিরোধীরা। যৌন নির্যাতনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে পুরো এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিলো। একের পর এক গণধর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল জলভাত। আতঙ্ক সৃষ্টি করে চুপ করিয়ে রাখা হত মানুষকে। বাড়ির চৌকাঠ পেরোতে ভয় পেত মেয়েরা।
তথ্য ঘাঁটলে দেখা যাবে, ২০০০-২০০২, এই দুবছরে প্রায় ৩৩টি ধর্ষণ ও ১২টি খুন হয় সুঁটিয়া এলাকায়। আর এই ধর্ষণ রুখতেই তরুন এই মাস্টারমশাই গড়ে তোলেন ‘সুঁটিয়া গণধর্ষণ প্রতিবাদ মঞ্চ’। শুরু হয় আন্দোলন, নৃশংসতা আর নিপীড়নের প্রতিবাদ। সেই প্রথম তালিকা করে শাস্তির দাবি করা হল সেই সব পিশাচদের। সকলের দরজায় গিয়ে কড়া নেড়ে সাহস দেওয়া হল এদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে।
প্রতিবাদের এই পর্বে আগাগোড়া সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বরুণ বিশ্বাস। তিনি তখন সুঁটিয়ার সাধারণ মানুষের কাছে সাহসের প্রতীক। নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার যারা, তাদের স্বাভাবিক জীবনে আসার জন্য উৎসাহিত করতেন তিনি, কয়েকজনের ধর্ষিতা মহিলার বিয়ের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। বিচার পাওয়ার আশায় অনেকে থানায় অভিযোগ দায়ের করার শক্তি পান বরুণের চেষ্টাতেই। যার ফলে ধরা পড়ে মূল অভিযুক্ত বীরেশ্বরসহ পাঁচজন। শাস্তি হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
তবে আজ তাঁর মৃত্যুর দশ বছর পরেও কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা? তাঁকে হারানোর পরে তাঁর অন্তিম যাত্রার শববাহী স্পর্শ করে গোটা সুটিয়াবাসী যে পণ করেছিল কি হল সেই শপথের? আজও গ্রামের মাস্টারদার খুনের মূল অভিযুক্ত অধরা। NCRB-র সমীক্ষা বলছে ২০২১ সালের শেষ গণনা অনুযায়ী ১৯৭৫ টি ধর্ষণের মামলা ঋজু হয়েছে গোটা ভারতবর্ষ জুরে। এখন প্রশ্ন…কতটা সফল হল বরুনের প্রতিবাদ? তিনি বলতেন, ‘প্রতিবাদীর মৃত্যু হলেও, প্রতিবাদের মৃত্যু হয়না’। আমাদের নতুন প্রজন্ম সেই বিপ্লবের মশাল বয়ে নিয়ে যেতে ঠিক কতটা অপারগ? প্রশ্ন তো উঠবেই। থাকবে অনেক অপ্রাপ্তি, বঞ্চনাও। তবে সন্মান্তরাল ভাবেই বাংলার বুকে বেঁচে থাকবে এক নির্ভীক, জেদি, একরোখা শিক্ষকের ইতিহাস। আর তাঁকে ঘিরে স্বপ্ন বাজি ধরবে নতুন যুব প্রজন্ম— সোশ্যাল মিডিয়া, রাজনৈতিক নেতাদের চিৎকার, খেলা-মেলা সহ সব মগজধোলাই সব কিছু উপেক্ষা করেই।