বিকল্পই স্বপ্নপূরণের দিশারী , তার জন্য লাগেনা দশ হাত
বাস্তবে যিনি দশভূজা, তার প্রয়োজন পড়েনা বাড়তি হাতের । কৃত্রিম হাতের সাহায্যে রোজ এগিয়ে চলেছেন নিজের লক্ষ্যের দিকে।

কলকাতা ও বর্ধমান : সরকারি হাসপাতালে নার্স হতে চাওয়ার শাস্তি হিসাবে মিলেছিল ডান হাতের কব্জি বাদ দিয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে । ঘুমের ঘোরে তার নিজের স্বামী তাকে শাস্তি স্বরূপ শরীরের প্রধান অঙ্গের মধ্যে একটিকে বাদ দিয়ে তাকে তার স্বপ্নপূরণের পথ থেকে পুরোপুরি মাটিতে নামিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। তিনি রেনু খাতুন।
তবে কি শেষ হয়ে গেলো রেনুর স্বপ্ন পূরণ ? না, কৃত্রিম হাতের উপস্থাপন ঘটলো রেনোর শরীরে । তবে , কৃত্রিম হঠের ব্যাবহার প্রত্যহ দিনের জীবনে জেকারুর পক্ষেই একটু কষ্ট সাধ্যর বিষয়ে। তবে রেনুকে দমানো অটো সহজ হলোনা । জীবনযুদ্ধে বিয়ই হলেন তিনি। আরজি কর হাসপাতাল থেকে নার্সিং প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। বেসরকারি হাসপাতালে নার্সের কাজ করেছেন। স্বামী শেখ সরিফুল মানতে পারেননি। স্ত্রীর চাকরি করা তাঁর পছন্দ ছিল না। ভাবতেন, সরকারি চাকরি পেলে স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে যাবেন! রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরে নার্সের পদে চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন রেণু। সেই ‘সরকারি’ চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল তাঁর। তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন স্বামী।বর্তমানে তিনি সরকারি নার্সিং কলেজে প্রশিক্ষকের চাকরি করছেন ।বর্ধমান শহরের বাজেপ্রতাপপুরে দিদির বাড়িতে থাকেন।
তবে ,রেনু জানিয়েছেন, তিনি দশটি হাত নিয়ে সকল শক্তির ভান্ডার অর্জন করতে চান না । কারণ তিনি বলেছেন , মা দুর্গার অবশ্যই দশটি হাত থাকতে পারে এবং তিনি গোটা জগতের শক্তি ধারিনি। তবে কি সাধারণ মানুষ যাদের জন্মই দু’হাতের ন্যায় তাদের কি সম্পূর্ণ শক্তিহীন বলা কি চলে ? এছাড়াও তিনি বলেছেন , ‘‘আমরা শিষ্য হতে পারি। গুরু কি হতে পারি? মায়ের মেয়ে হতে পারি। মা নয়।’’
সালটি ছিল ২০২২ সালের ৪ জুন ।শ্বশুরবাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন রেণু। আচমকা ঘুম ভাঙ্গার পরই চিৎকার। মুখের উপর বালিশ চাপা থাকে কেউ তার শব্দ পর্যন্ত পায়নি। তখনো ডান হাতে হাতুড়ি পিটছেন স্বামী। তার পরে টিন কাটার কাঁচি দিয়ে কব্জি থেকে কেটে নিলেন রেণুর হাত। তার স্বামীর সাথে ছিলেন আরও তিন জন। আহত রেণু প্রথমে ছিলেন কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে। সেখান থেকে বর্ধমান সদর হাসপাতাল। তার পরে দুর্গাপুরের বেসরকারি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করান বাপের বাড়ির লোকজন। থানায় অভিযোগ করেন রেণুর বাবা আজিজুল হক। দু’দিন পর গ্রেফতার হন তাঁর স্বামী। এর পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে চাকরি পেয়েছেন রেণু। কৃত্রিম হাত হয়েছে তাঁর।
তবে , তার এই এগিয়ে যাবার পথ পেয়েছেন তার আরও একবার জন্ম নেবার পরই। কিন্তু মনে কিছু যন্ত্রণা প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খায় তাকে। যে রেনু আগের মত চটপটে ছিল সেই রেনু আরে আজকের রেনু একেবারে ভিন্ন । তবে হেরে যাননি। নার্স হয়ে মানুষের সেবা না করতে পারলেও কাউকে মানুষকে সেবা কিভাবে করতে হয় তা শেখানো তার কাছে অনেক বড় পাওনা।
তবে এই সবকিছুর মধ্যেও মনে পড়ে তার পুজোর কথা সাথে তার আগের জীবনের কিছু স্মৃতি। নার্সিং কলেজ যাওয়ার পথে দেখেছেন, একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে মণ্ডপ। কাঠামোয় মাটি পড়েছে। মাটির উপর রং। রঙের উপর জরিদার কাপড়। বর্ধমান শহরে অনেক পুজো সহকর্মীদের সঙ্গে পুজো দেখতে চান রেণু। ভাবেন, ‘‘কী জানি, কাল কী হয়! কারণ এইভাবেই তো ভাবতে পারেননি যাকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসাবে বেছে নেবেন সে একজন দানব রুপী অসুরে পরিণত হবে। সেদিন তিনি পারেননি অসুরকে নিধন করতে।
নিজের পছন্দ করা ছেলের সাথেই ভগবানকে সাক্ষী রেখে কুবুল করেছিলেন এই বিয়েটা। পরিবারের তরফে অমত থাকলেও পরবর্তীতে তারাও মেনে নেন সম্পর্কটিকে তাদের ।
তাঁর পাঁচ বছরের দাম্পত্যেও পুজো এসেছে। কোজলসা গ্রামে ছিল তাঁর শ্বশুরবাড়ি। সেখানেও দুর্গাপুজো হত না। দূরের গ্রামে পুজো হত। তবে তার ঢাকের শব্দ কোজলসায় এসে পৌঁছত না। তখনকার দুর্গাপুজোর স্মৃতি বিশেষ নেই রেণুর। রয়ে গিয়েছে শুধু সেই রাতের স্মৃতি। যে রাতে সব বদলে গিয়েছিল।
কিন্তু রেনু তার স্বপ্নকে ভঙ্গ হতে দেবেননা । ভগবানই চায় যখন আজ তিনি এই স্থানে দাঁড়িয়ে আছেন আরও বেশি করে এগিয়ে নিয়ে যাবেন নিজেকে । বাধা বিপত্তি যতই আসুক সব কিছুর উর্দ্ধে তার স্বপ্নই থাকবে।