কান পাতলে শোনা যায় ইংরেজদের কান্নার আওয়াজ! হাজারো রহস্য নিয়ে আজও ঘুমিয়ে পার্কস্ট্রিট সেমিট্রি

রাখী পোদ্দার, কলকাতা : ইউরোপ অথবা আমেরিকা নয় কল্লোলিনী কলকাতায় ( Kolkata) নাকি আজও জেগে ওঠে পুরোনো কলকাতার সকল সৃতি। কলকাতার বুকে এমন বহু জায়গাই রয়েছে যেখানে গেলেই গা ছমছম করে উঠবে আপনারও। আর তেমনই একটি জায়গা হল কলকাতার সাউথ পার্কস্ট্রিট সেমিট্রি ( Park Street Cemetery)। এই সেমিট্রিতে গেলে আজও শোনা যায় নানান অদ্ভুত সব গল্প। আত্মাদের ফিরে আসার সব অলৌকিক ঘটনা। হাঁড় হিম হয়ে যায় নাকি সেইসব ব্রিটিশ বিরোধীদের কান্না শুনলে। তবে সকালে এখানে শুধুই বিরাজ করে শান্তি। ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় ভেসে যায় কবরগুলো। আরামে সেইসব কবরে শুয়ে থাকে কত অতৃপ্ত কঙ্কাল। আর তারই পাশ দিয়ে স্বচ্ছন্দে হেঁটে যায় কত তরুণ তরুণীরা। সকালের সেমিট্রি মৃত্যুর নয় বরং প্রেমের।
এজেসি বোস রোড এবং পার্ক স্ট্রিটের সংযোগস্থলে বিশাল এলাকা জুড়ে বিরাজমান এই গোর স্থান। ইংরেজ আমলে প্রস্তুত এই সেমেট্রি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ইউরোপ আর আমেরিকার বাইরের সবথেকে বড় খ্রিস্টানদের কবরখানা হল এই সাউথ পার্ক স্ট্রিট সেমেট্রি। চার্চবিহীন কবরস্থানের এক বড়ো উদাহরণও ছিল পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি। কেননা সেই সময়ের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চার্চের সঙ্গে সিমেট্রি গড়ে ওঠাই ছিল রেওয়াজ। এখানে প্রথম কবরটি ১৭৬৭ সালের। মাঝে কিছু সময় বন্ধ থাকলেও ১৭৯৬ সালে পুনরায় এটি চালু করা হয়। ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত মৃত দেহগুলি কবর দেওয়া হত এখানে। এরপর এখানে কবর দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। বর্তমানে খ্রিস্টান ব্যারিয়াল বোর্ডের অধীনে রয়েছে এই পার্ক স্ট্রিটের এই সেমেট্রি। পার্ক স্ট্রিটের এই সেমেট্রির ওপর চাপ কমাতে ১৮৪০ সাল নাগাদ সার্কুলার রোডের পূর্ব দিকে আরও একটি কবরস্থান গড়ে তোলা হয়েছিল। প্রায় ১৬০০ বেশি সমাধি সৌধ রয়েছে এখানে।
সিমেট্রি ভালো করে ঘুরে দেখলেই কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য করা যায়। বেশিরভাগ কবরগুলির ফলকে যে জন্ম এবং মৃত্যুর তারিখ দেওয়া আছে তা থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট, এই কবরস্থানে যাদের কবর দেওয়া হয়েছিল তাদের অধিকাংশেরই বয়স তিরিশের কম। পার্কস্ট্রিট সিমেট্রির চারপাশের ইইতিহাসে এমনই বহু রসদ বিরাজমান যা যুগ যুগ ধরে রহস্য তৈরি করেছে সাধারণ মানুষ থেকে গবেষকদের মনে। সত্যজিৎ রায়ের কাহিনী অবলম্বনে সন্দীপ রায় পরিচালিত ‘গোরস্থানে সাবধান’ ( Gorosthane Sabdhan) সিনেমার বেশ কিছু দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিতে। এই সেমেট্রিতে চোখে পড়বে বেশ কিছু খ্যাতনামা ইংরেজদের কবর ও সৌধ। এঁর মধ্যে রয়েছেন উইলিয়াম জোন্স, হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ( henry louis vivian derozio), এলিজা ইম্পে, চার্লস স্টুয়ার্ট ( charles stewart) প্রমুখ। এর মধ্যে চার্লস স্টুয়ার্টের সৌধটি বেশ কারুকার্যময়। যেখানে মধ্যযুগের শেষ দিকের মন্দির স্থাপত্যের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে। পদ্মাকৃতি ছাদ, পঞ্চরত্নের প্রভাব, খিলানাকৃতি প্রবেশদ্বার, চামুন্ডার খোদিত মূর্তি, যা কিনা হিন্দু মন্দির শিল্পের অথবা মুসলিম সৃতি সৌধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এই সেমেট্রির আরও একটি দিক আছে। যেগুলো এখনও মানুষকে শিহরিত করে। কথিত আছে এখানে কান পাতলে আজও শোনা যায় ইংরেজদের আর্তনাদ। সিমেট্রির প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকলেই প্রথমে চোখে পড়বে সারিবদ্ধ সমস্ত সৃতিসৌধ। যার মাঝখান একটি সরু রাস্তা এগিয়ে চলেছে। কত কিছুই না লুকিয়ে আছে এইসব সৃতিসৌধের মধ্যে। সকাল হোক কিংবা রাত সবসময়ই এখানকার পরিবেশ যেন থাকে গা ছমছমে। সঠিক পরিচর্যার অভাবে এখন জরাজীর্ণ অবস্থা এই গোরস্থানটির। অথচ হেরিটেজ সাইটের তকমা পাওয়ার সবরকম রসদই রয়েছে এই পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিতে। এখনও মাঝে-মাঝে বিদেশিদের দেখা যায় এখানে, যাঁরা আসেন তাঁদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। যদি এই গোরস্থান সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় তবে ইতিহাসের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে নতুন প্রজন্মের ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে।