Biman Bose: ৮৩ নট আউট! প্রেমে পড়েছিলেন ‘চেয়ারম্যান’? শেষে কাটাতে চেয়েছিলেন সন্ন্যাসীর জীবন?

সৌমি ঘোষ,কলকাতা: ‘চলে যাব, তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল’ কবি সুকান্তের এই কবিতাই যেন ধ্রুব সত্য হয়ে উঠেছে সিপিআইএমের বর্ষীয়ান নেতা বিমান বসুর জীবনে। ৮৩-তেও ‘আনস্টপেবল’ বিমান। আজও দলের প্রয়োজনে মাঠে নামতে পিছপা হন না এই তিরাশির তরুণ। স্লোগান থেকে মিছিল, কৌটো হাতে অর্থসংগ্রহ থেকে ভোট কুশলী, সবক্ষেত্রেই এখনও ৮৩ নট আউট বিমান। শুরু থেকেই একই ভাবে বামফ্রন্টের প্রাণভোমরা হয়ে রয়েছেন জ্যোতি ঘরানার এই বর্ষীয়ান নেতা। যখম, এ ফুল থেকে ও ফুলে ঝুঁকেছেন রাজনৈতিক নেতারা, রাজনীতির জটিল ধাঁধাঁ থেকে ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে দলীয় নীতি আদর্শের নাম তখনও প্রাচীন বট গাছটির মতো শিকড় আঁকড়ে রাজনীতির পাঠ দিচ্ছেন বিমান বসুর মতো প্রবীন নেতারা। ‘সব পাওয়ার’ ক্ষমতার রাজনীতি নয় বরং সব হারিয়ে একমাত্র দলকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। একে একে ছেড়েছেন ঘর, মায়ের আঁচল,প্রথম প্রেম আর সুনিশ্চিত জীবনের হাতছানি। বিমান বসুর জীবন সমুদ্রে ঝাঁপ দিলে এমন অনেক তথ্য পাওয়া যায়, যা সকলের চোখ এড়িয়ে সমাধিস্থ হয়ে গেছে পার্টির সততার কাছে।

img 20220712 170648

ইয়ে আজাদি ঝ্যুটা হ্যা

অকৃতদার ,সংযমী,পরিশ্রমী,নিষ্ঠাবান সৎ কমিউনিস্ট নেতা বলে পরিচিত বিমান বসুর জীবনে লুকিয়ে রয়েছে অনেক রহস্য। ছোটবেলা থেকেই জ্ঞান চর্চা আর কৌতূহলী মন নিয়ে হাতের সামনে যা পেয়েছেন তাতেই ডুবে গিয়েছেন। পড়েছেন একাধিক স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের উপরে বই। মনে জেগেছে হাজারও প্রশ্ন,পারিবারিক পরিসরে তার একটি উত্তরও পাননি। কৈশোরে নিজের চোখে দেখেছেন ভগ্ন স্বাধীনতা। দেশভাগের সময় উদ্বাস্তু মানুষের যন্ত্রণা আর রাসবিহারীর মোড়ে লাল ঝান্ডা কাঁধে অগুনতি মানুষের জনস্রোত। মর্মে গেঁথে গিয়েছিল একটাই স্লোগান ‘ইয়ে আজাদি ঝ্যুটা হ্যায়।’ ওই বয়সে শব্দের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পাননি, শুধু জেনেছিলেন যাঁরা এই মিছিল করে তারা কমিউনিস্ট।

প্রেম এসেছিল জীবনে

কিন্তু বয়স থেমে থাকে না, আর পাঁচ জনের মতো কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিয়েছিলেন ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা। বয়সের নিয়মেই প্রেম এসেছিল জীবনে। কোনও তরুণী যে মনেরক সাগরে হিল্লোল তোলেননি তা নয়। শোনা যায়, কলেজ জীবনেই পরিচয় হয়েছিল একজন বুদ্ধিমতী অষ্টাদশীর সঙ্গে। কিন্তু প্রেম মানেই তো বন্ধন। অথচ সেসময় মাথার ভেতরে থাকা ‘আজাদি’,’ঝুটা’, ‘কমিউনিস্ট’ শব্দ গুলো ঝড় তুলছিল। তাই সম্পর্ক আর বেশি দূর গড়ানোর আগেই নিজেই বিনাদোষে একদিন খেলেন পুলিশের লাঠি। স্বাধীনতার পরও কংগ্রেসি পুলিশের অত্যাচার তালগোল করে দিল তাঁর জীবনের সমস্ত পরিকল্পনা। এ সময় ভেবে ছিলেন সব ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়ে যাবেন। শোনা যায় গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগও ছিল তাঁর। সমস্ত প্রশ্নের নিরসন করতে সন্ন্যাসীদের মহলে যাতায়াত করা শুরু করেন। স্বামী লোকেশ্বরা নন্দের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন মোক্ষ পথ ভাল,তবে সেই ভুল ভাঙে প্রবীন কমিউনিস্ট নেতা বিনয় চৌধুরীর সান্নিধ্যে। এই প্রথম সরাসরি রাজনীতিতে হাতেখড়ি ঘটে বিমান বসুর।

img 20220712 165325

রাজনীতিই জীবন

রাজনীতির ময়দানে এসে বুঝলেন এখানেই এতদিনের জমা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।পথটা মোটেও সোজা ছিল না। প্রথম প্রথম দাদাদের কাছে মারও খেয়েছিলেন। কেউ চাননি রাজনীতির ঝক্কি বাড়ি পর্যন্ত গড়াক। ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন পারিবারিক আবহ থেকে। মাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন বিমান বসু। পার্টির হোল টাইমার হয়ে পড়ার পরই মায়ের থেকেও দূরত্ব বাড়তে থাকে। দিনের পর দিন বাড়ি ফিরতেন না। বাধ্য হয়েই তাঁর মা ভেবেছিলেন প্রেম করছে ছেলে, অন্য কোথাও ঘর বেঁধে থাকছে। শোনা যায়, লোকও লাগিয়েছিলেন তিনি। তবে ছেলের ভালোবাসা তখন একটাই পার্টির সংগঠন। রাজ্যের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছেন। কোনওরকম খেতে হয় খাচ্ছেন, যেখানে জায়গা পাচ্ছেন শুচ্ছেন। তারপর পার্টির হোল টাইমার হিসেবে জুটল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের একটা ছোটো ঘর। সেখানেই বাকিটা জীবন। পার্টির কাজ বাদে, একলা নিঃসঙ্গই কাটে সারাবেলা।

img 20220712 171618

অচেনা বিমান

কার্যত এক কামড়ার ঘরে সন্ন্যাসীর জীবন কাটাচ্ছেন বিমান বসু। তবু কি ছাড়া যায় প্রেম, বাৎসল্য, মায়া? বাচ্চাদের অসম্ভব ভালোবাসেন তিনি। সংসার সন্তান কিছুই পাননি জীবনে।দলকে পেতে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে নেমে এসেছে একাকীত্বের ছায়া। সেজন্য যেখানে ছোট ছেলেমেয়েদের দেখা পান, তাদের বই-পেন এগিয়ে দিতে দেখা যায়। এই কিছু দিন আগেই ভোটের সকালে দেখা গিয়েছিল, সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পড়ে ‘৮৩’র যুবক বিমান বসু ক্রিকেট খেলছেন বাচ্চাদের সঙ্গে। ভাবুন তো একবার! গুরু গম্ভীর সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা রাজনৈতিক বাগ্মীর সঙ্গে মেলাতে পারেন এই ছবিকে?




Back to top button