Surya Sen : যুব দিবসের ছটায় কী ঢাকা পড়ছে সূর্যের গরিমা, আত্মবলিদান দিবসে ফিরে দেখা মাস্টারদার সংগ্রামী ইতিহাস

রত্নগিরির কনডেম্‌ড সেলের প্রতি কোণায় ভেসে আসছিল সেদিন রবিঠাকুরের “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে” গানটা। গান শোনার শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল তাঁর( Surya Sen )। কার কথা বলছি সেই প্রসঙ্গে আসবো ধীরে ধীরে। প্রথমেই যেটি বিশেষ ভাবে বলার ভারত বাসীর কাছে ১২ই জানুয়ারি একটি বিশেষ দিন। যেকোনো ভারতীয়কে ১২ জানুয়ারির কথা জিজ্ঞেস করলে এক বাক্যে বলবেন স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিবস তথা যুব দিবস। এই দিবসে সেজে ওঠে ভারত তথা বিদেশের মিশন গুলি। আলো দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো হয় প্রতিটি মিশন। স্বামী বিবেকানন্দের জন্মস্থান সহ বহু জায়গায় চলে স্বামীর কর্ম কথা। কিন্তু ভারত এই দিনটি জাকজমক পূর্ণ ভাবে কাটালেও ভুলে যায় ঠিক এই দিনেই হয়ে যাওয়া ভারতের স্বাধীনতার স্বার্থে একটি সাধারণ শিক্ষকের আত্মবলিদানের প্রতি ব্রিটিশদের এক পৈশাচিক অত্যাচারের ঘটনা। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন তিনি হচ্ছেন‘যুগান্তর’ দলের চট্টগ্রাম শাখার প্রধান এবং ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের প্রধান সংগঠক মাস্টারদা সূর্যসেন। এই দিনে মাস্টারদা কে মৃত অবস্থায় ফাঁসি দিয়েছিল ব্রিটিশ বাহিনী। সেই প্রসঙ্গতে যাওয়ার আগে জেনে নেওয়া যাক মাস্টার দার শিক্ষাজীবন সহ বিপ্লব জীবনের কথা।

Surya Sen থেকে মাস্টারদা Surya Sen হওয়ার কথা

মাস্টার সেনের জন্ম হয় চট্টগ্রাম রাউজান থানার এক অস্বচ্ছল পরিবারে। শৈশবেই তিনি নিজের পিতা মাতাকে হারিয়ে ফেলেন। তাই তাঁর কাকা গৌরমনি সেনের কাছেই সূর্য সেন মানুষ হতে থাকেন। খুবই মেধাবি ছাত্র হওয়ায় হাই স্কুল পাশ করেই তিনি চট্টগ্রাম কলেজে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ভালো ফল নিয়ে পাশ করেন। সেখান থেকেই তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। উচ্চ শিক্ষার পর সূর্য সেন মুর্শিদাবাদের একটি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। যদিও সেই কলেজ বন্ধ হয়ে যায় অসহযোগ আন্দোলনের জন্য। এরপর তিনি দেওয়ানবাজারে বিশিষ্ট উকিল অন্নদা চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত অধুনালুপ্ত ‘উমাতারা উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে’ অঙ্কের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। যেখান থেকেই তার বিপ্লব ও বিপ্লবের ভাবধারার প্রতি টান বাড়তে থাকে। এবং তিনি বিপ্লবী দলগুলোর সাথে গভীর যোগাযোগ স্থাপন করতে থাকেন। সূর্য সেনের শিক্ষকতা পেশা হওয়ার কারণে তখন তাঁর নাম হয় ” মাস্টারদা সূর্য সেন”।

Surya Sen
সূর্য সেন

মাষ্টারদা Surya Sen- এর বিপ্লবী দল গঠন

সেই সময় চট্টগ্রামে তখন বিপ্লবী দলে কাজ করতেন আম্বিকা চক্রবর্তী, অনুরূপ সেন, নগেন সেন (জুলু সেন), চারুবিকাশ দত্ত সহ আরো অনেকে। কিন্তু তাঁদের কাজের সাথে দেশের প্রতি তৎপরতা ছিল সীমিত পর্যায়ের। বাংলাদেশে বিপ্লবীরা তখন অনুশীলন ও যুগান্তর এই দুই দলে বিভক্ত ছিলেন। সূর্যসেন যুগান্তর দলে যোগ দিয়ে সংগঠনটিকে সক্রিয় করে তোলেন এবং বিরোধী দল দুইটিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। যেহেতু প্রধান বিপ্লবী দল ছিল যথাক্রমে যুগান্তর এবং অনুশীলন। পাশাপাশি মাস্টারদাও চেয়েছিলেন দুই দলের শক্তি একত্রিত হলে ব্রিটিশ বিরোধী যে শক্তি তারা তৈরি করতে চাইছেন তা সম্ভবপর হবে। সেই জন্যই তিনি এই চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এবং সময়ের সাথে তাঁর দল চট্টগ্রামে সক্রিয় হয়ে ওঠে। যুক্ত হয় নতুন মুখ ও। এরপর চলতে থাকে একে একে ভারতের ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা এবং ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন।প্রাথমিক পর্যায়ে অহিংস ও নিয়মতান্ত্রিক পথ ধরে বিপ্লবের সূচনা হলেও সময়ের ব্যবধানে সংগ্রামের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে হিংসাত্মক কর্মনীতি বা বিপ্লববাদ দেখা দেয়।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রধান মুখ মাস্টারদা Surya Sen

নাগরখানা পাহাড় খন্ডযুদ্ধ, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন ও জালালাবাদ যুদ্ধ সহ তাঁর ও তাঁর দলের নাম জুড়ে যায় ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ- এও। এই সমস্ত কর্মকাণ্ডে অনেক বিপ্লবি ও বিপ্লবীনি শহীদ হন যাঁদের নাম ভারতের স্বাধীনতা ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে।এই সমস্ত আন্দোলনের প্রধান মুখ ও মাথা মাস্টারদা সূর্যসেনকে ইংরেজ প্রশাসন জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় ধরার জন্য সবজায়গায় খানা তল্লাশি চালায়। তিনি তখন গৈরলা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে আত্মগোপন করে ছিলেন। ১৯৩৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি রাতে সেখানে এক বৈঠকে ছিলেন কল্পনা দত্ত, শান্তি চক্রবর্তী, মণি দত্ত, ব্রজেন সেন আর সুশীল দাসগুপ্ত।

Surya Sen
সূর্য সেন
গ্রেপ্তার মাষ্টারদা Surya Sen, সাথে ব্রিটিশদের পৈশাচিক অত্যাচারের কথা

কোনোদিনই মাষ্টারদাকে ইংরেজ প্রশাসন খুঁজে পেতনা যদি না ব্রজেন সেনের সহোদর নেত্র সেন সূর্য সেনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করত। নেত্র সেন মাস্টারদার উপস্থিতির খবর পুলিশকে জানিয়ে দেয় এবং অবশেষে পুলিশ মাস্টার দাকে গ্রেপ্তার করেন। এরপর তাকে রাখা হয় রত্নগিরির কনডেম্‌ড সেলে। সেখানে শুরু হয় ব্রিটিশদের পৈশাচিক অত্যাচার। দিনের পর দিন করতে থাকে ব্রিটিশরা তার উপর নির্মম অত্যাচার। পিটিয়ে শরীরের সমস্ত হাড় ভেঙে দেওয়া হয়েছিলো তাঁর ৷ ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করে ভেঙে দেওয়া হয়েছিলো তার সব কটা দাঁত৷ টেনে টেনে উপড়ে ফেলা হয়েছিলো হাত ও পা এর সমস্ত নখ৷

অবশেষে বিদায় মাষ্টারদা Surya Sen

অবশেষে তাঁর ফাঁসির আদেশ আসে ১৯৩০সালের ১২ জানুয়ারি। যদিও ততদিনে মৃত হিসাবেই ধরা হয়েছিল মাস্টার দা কে। তবু মিথ্যা ফাঁসি দেওয়া হয় সেদিন ৷ সারা দেশ তাঁর ফাঁসির খবরে ভেঙে পড়েছিল। এমন কি মৃত্যুর পর তার দেহ তুলে দেওয়া হয়নি পরিজনদের হাতে৷ ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিলো সমুদ্রের বুকে, ঠিক যেভাবে আমরা কোনো আবর্জনাকে ছুঁড়ে ফেলি সমূদ্র বক্ষে। স্বাধীনতার তরে ভারতের জন্য এই বিপ্লবীর বলিদানকে ভোলা চলেনা। এক সাধারণ মাস্টার মশাইয়ের এত বড় আত্মবলিদান দেশের জন্য আজকের যুব সমাজ তথা সকল স্তরের ব্যক্তিকে ভাবাতে বাধ্য করে। মাস্টার দাকে ভোলা চলেনা তবু ভুলে যায় কারণ ‘ইতিহাস তো ইতিহাসই’।

 

আরও পড়ুন: National Youth Day : বিবেকানন্দ জন্মদিনে মেতেছে রাজনৈতিক নেতারা, চলছে বাণী লিখে টুইট

 




Leave a Reply

Back to top button