একরত্তি অপু থেকে ক্ষুরধার ফেলু! অস্কার প্রাপ্তির বছর তিরিশ পরেও আজও সত্য সত্যজিৎ

একটা গোটা মহাকাশের নাম সত্যজিৎ। তাঁর অগুণতি প্রতিভা সেখানে অসংখ্য তারার মত আজও অমর হয়ে বহু শিল্প-পথিকদের দিকে চিনিয়ে যাচ্ছে। তাঁকে নিয়ে কিছু লেখা চাট্টিখানি কথা নয়। একটা ক্যানভাস দিয়ে তোমায় যদি বলেন কেউ, আস্ত আকাশের একটা ছবি আঁকো। পারা সম্ভব? খুব বেশি হলে একটা আকাশের দিক আনার চেষ্টা করা যেতে পারে। সাতবারের চেষ্টা করার পরেও মনে হবে না আরও কিছু বাকি ছিল। আর তখন মনের কোন থেকে ফেলু মিত্তির মন্তব্য করে উঠবেন ‘আটে শুধরে নেবেন।
বছরের পর বছর ধরে সিনে-আমোদীরা তাই করে যাচ্ছেন। কিন্তু আজও তাঁরা সবাই মিলেও গোটা আকাশটাকে ধরতে পারেননি। যার ফলে আজও সেই খোঁজার ট্র্যাডিশন সমানভাবে চলিতেছে এবং সগৌরবে চলিতেছে। মুশকিল যে অন্যখানে, আকাশটাও যে বাড়ছে। এই আর্ন্তজালি আমোদের যুগেও যখন দেখা যায় যে নতুন প্রজন্ম ঝুঁকছে সেই ছয় ফিট সাড়ে তিন ইঞ্চি মানুষটার হাঁটুর কাছে, তখন সত্যিই প্রশ্ন জাগে কি পাচ্ছে তারা যার জন্য তাঁদের অ্যাভেঞ্জার্স-রেয়াজি স্পেশ্যাল এফেক্টস রুচি, গুপি বাঘা’র হাততালিতে ভ্যানিশ হয়ে যাওয়ার সেই জর্জ মেলীয় ট্রিক ফটোগ্রাফিকেও ‘ওল্ড স্কুল’-এর তকমা দিতে পারছে না। সাড়ে এগারো টোক নোলান (আদি), দশ মুঠো ফিঞ্চার আর নয় চামচ ট্যারান্টিনো ঘেঁটে গুলে খেয়েও ‘সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ পাড়ে পড়লে ‘সরি, ডায়েটে আছি’ বলে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে না উল্টে নেটে একটা ‘ভালো দেখে’ এইচডি ভার্শন খুঁজতে চাইছে?
উত্তর একটাই, ন্যারেশনের সময়াতীত আবেদন। শন কোনারি যেমন আর বড় করবো না ভেবেও ফিরে এসেছিলেন ১৯৮৩-তে ‘ডাই অ্যানাদার ডে’-তে তাঁর বলিরেখা সমেত সেইভাবেই সব্যসাচীও যখন ফের ফিরে আসেন ২০১৬-তে ‘ডবল ফেলুদা’-য় তাঁর ডবল চিন নিয়ে ছবি তখনও হাউসফুল হয়। কারণ ঐ একটাই। ফেলুদাকে (পড়ুন রায়মশাইয়ের গল্প) পর্দায় দেখবো বলে।
বাঙালিকে অনেক গর্বের দিন দিয়ে গিয়েছেন সত্যজিৎ। তেমনই একটি দিন হল ৩১শে মার্চ,১৯৯২, ওই দিনই অস্কারের স্বাদ পেয়েছিল বাঙালি। কলকাতায় তখন গভীর রাত। ওদিকে আমেরিকায় সেদিন সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে অস্কার। ঘোষিত হচ্ছে লাইভ টাইম অ্যাচিভমেন্ট বিভাগে আস্কার প্রাপকের নাম, একজন বাঙালির নাম! তিনি সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ রায়ই হলেন অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড অর্থাৎ অস্কার জয়ী প্রথম বাঙালি। যদিও শারীরিক অসুস্থতার কারণে পুরস্কার নিতে আমেরিকায় যেতে পারেননি সত্যজিৎ। কলকাতায় তখন তিনি মৃত্যুশয্যায়।
প্রসঙ্গত, শরীর তাঁর সঙ্গ দিচ্ছিল না, তবুও মনপ্রাণ জুড়ে শুধুই চলচ্চিত্র। ১৯৮৩ সালে সত্যজিতের প্রথম প্রথমবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। কমিয়ে দিয়েছিলেন কাজ। জানা যায়, ১৯৮৩ সালে তখন ঘরে বাইরে ছবির শুটিং চলছিল, তখনই হৃদরোগ আক্রান্ত হন সত্যজিৎ। এরপরেই ক্যামেরা ব্যবহার ছেড়ে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। ১৯৮৪ সালে সন্দীপ রায়কে সঙ্গে নিয়ে ওই ছবির কাজ শেষ করেন। ১৯৮৭ সালে তাঁর বাবা সুকুমার রায়ের জীবননির্ভর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন।
আরও পড়ুন এপ্রিলেই শুরু হচ্ছে নতুন জ্যোতিষ বর্ষ, নতুন চাঁদকে সঙ্গে নিয়ে কেমন যাবে আপনার ভাগ্য
এরপর গণশত্রু, শাখা প্রশাখা এবং ১৯৯১ সালে আগন্তুক নির্মাণ করেন। ১৯৯২ সালের মার্চ মাসে হৃদযন্ত্রের জটিলতার কারণে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। প্রায় একমাস ভর্তি ছিলেন সেখানেই এবং ৯২-এর ২৩শে এপ্রিল প্রয়াত হন সত্যজিৎ।
জীবনের প্রান্ত সীমায় পৌঁছে মৃত্যুশয্যায় অস্কারের লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট (৬৪তম অস্কার) পুরস্কারে ভূষিত হন সত্যজিৎ। অ্যাকাডেমি মোশন অফ পিকচার্স কর্তৃপক্ষ কলকাতার হাসপাতালে এসে সত্যজিতের হাতে পুরস্কারটি হাতে তুলে দেয়। ৩১শে মার্চ আমেরিকার আস্কারের মঞ্চ থেকে সত্যজিৎ রায়ের নাম ঘোষণা করেন হলিউডের খ্যাতনামা অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্ন। মৃত্যুশয্যা থেকেই সত্যজিৎ পুরস্কার জয়ের পরে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানান। অস্কার মঞ্চের পর্দায় ভেসে ওঠেন সত্যজিৎ, আপামোর বাঙালিকে গর্বিত করেছিল মধ্যরাতের সেই মুহূর্ত। বিশ্ব সেদিন শেষবারের জন্যে প্রত্যক্ষ করেছিল ভারতীয় চলচ্চিত্রের অতিমানবীয় এক প্রতিভাকে
কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে বলা হয় যে তাঁরা সময়ের আগে এসেছিলেন। কিন্তু আসল কথাটা যে এই মানুষগুলি না এলে সময়টা আসত না। সত্যজিৎ এরকমই এক ভাগীরথ যিনি আন্তর্জাতিকতাকে এনেছিলেন বাংলার বুকে তাঁরা তামাম সৃষ্টিতে। এই ডিজিটাল যুগে উনি বেঁচে থাকলে হয়ত মাসে একটা করে ছবি বানাতেন। লেখাটার শুরুতে আকাশের ছবি আঁকার তুলনা টানার সময় একটা লিমিটেশনের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। ফ্লেম জুড়ে যতই কোবাল্ট বা প্রুশিয়ান ব্লু চাপানো যাক না কেন, ছবিতে কিছু মেঘ সবসময়েই অর্ধেক ধরা পড়ে কোথাও বুঝিয়ে দেয় আকাশটা এই ফ্রেমটার বাইরেও আছে।
সেইরকমই এই মহাকাশ যে এই ছোট ক্যানভাসেও যে ধরা পড়বে না এ আর বিচিত্র কি পরিশেষে একটা কথা বলা দরকার আর সেটা হল, এই লেখাটা যদি ভালোভাবে পরে দেখেন তাহলে চতুর পাঠক বুঝবেন যে লেখক নতুন কিসুই ল্যাখেন নাই, তবুও লেখাটা পড়ে ফেলা; কারণ? ঐ নামটা সত্যজিৎ রায়। চলচ্চিত্রের সেরার শিরোপা পাবার বছর তিরিশ পরেও যে পড়িছে বসি আমার লেখাখানি তাঁদের কাছে আজও সিরফ ঐ নামহি কাফি হ্যায়। তাঁর জন্মের অবলীলায় যেভাবে অ্যাভেঞ্জার্স সত্যি, আইন সত্যি, সোশ্যাল মিডিয়া সত্যি, নেটফ্লিক্স সত্যি তেমনভাবে তিনিও সত্যি, চিরন্তন সত্যের মতনই—সত্যজিৎ।
আরও পড়ুন Shah Rukh Khan: এখনই লঞ্চ করবে না SRK+, নতুন বিজ্ঞাপনে সালমানের প্রসঙ্গ তুললেন শাহরুখ