রক্তাক্ত বঙ্গভূমি! ফিরে দেখা রাজনৈতিক গণহত্যার নারকীয় রক্তমাখা ইতিহাস

একটি প্রবাদ বাক্য এই প্রতিবেদনের সাথে একেবারে মানাইসই, ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, প্রাণ যায় উলুখাগড়ার’ । রাজনৈতিক হিংসায় বারবার লাল হয়েছে বাংলার মাটি। বাংলার মাটিতে রাজনৈতিক হিংসা নতুন কিছু নয়। তৃণমূল কংগ্রেস এককালে এই ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। আজ সেই তৃণমূল জমানাতেই বারবার উঠেছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ। এই আবহে ফিরে দেখা যাক বাংলার ইতিহাসের রক্তাক্ত কিছু ঘটনা (Political Massacre in West Bengal)…
১৯৭৭ সালে বামপন্থীরা ক্ষমতায় আসে, এবং তারা টানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল। জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন প্রথম দুটি সরকার জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়নবাদ, একাধিক কারখানা বন্ধ ও ধর্মঘট ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিল। এই সময়কালে জেলাগুলিতে সিপিআই(এম) নেতারা নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। জ্যোতি বসুর আমলে প্রশাসনের হাতও রক্ত রঞ্জিত হয়েছিল।
সাইঁবাড়ি হত্যাকাণ্ড – ১৯৭০ সালের ১৭ মার্চ বর্ধমান শহরে এই হত্যাকাণ্ড (Political Massacre in West Bengal) সংগঠিত হয়েছিল। প্রতাপেশ্বর শিবতলা লেনে অবস্থিত সাঁইবাড়িতে ঢুকে তিনজনকে হত্যা করেছিল বাম সমর্থকরা। উল্লেখ্য, সাইঁরা ছিলেন কংগ্রেস সমর্থক। সেই ঘটনায় ছেলের রক্তমাখা ভাত খেতে বাধ্য করা হয়েছিল মৃতদের মাকে। ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত নিরুপম সেন পরবর্তীতে রাজ্যের মন্ত্রী হয়েছিলেন।
মরিচঝাঁপি গণহত্যা – ১৯৭৯ সালের ২৪ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের উৎখাত করার নামে মরিচঝাঁপিতে চলেছিল হত্যালীলা (Political Massacre in West Bengal)। বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে আসা উদ্বাস্তুরা চেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে থাকবেন। তাই দণ্ডকারণ্য থেকে সুন্দরবনের মরিচঝাঁপিতে এসেছিলেন তাঁরা। সেই উদ্বাস্তুদেরই নির্বিচারে হত্যা করেছিল বাম শাসিত সরকারের পুলিশ।
১৯৮২ সালে জ্যোতি বসুর শাসনব্যবস্থা আবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়, যখন সিপিআই(এম) শ্রমিকরা দক্ষিণ কলকাতার প্রাণকেন্দ্র বিজন সেতুতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী আনন্দ মার্গের ১৭ জন সন্ন্যাসীকে ছেলে ধরা গুজবে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করেছিল (Political Massacre in West Bengal)।
মহাকরণ অভিযানে পুলিশের নির্বিচার গুলি – ১৯৯৩ সালের ২১শে জুলাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মহাকরণ অভিযান করেছিলেন যুব কংগ্রেস কর্মীরা। সেই মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। তাতে ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মী প্রাণ হারিয়েছিলেন।
নানুর হত্যাকাণ্ড – ২০০০ সালে বীরভূমের নানুরে ১১ জন সাধারণ মানুষকে খুনের অভিযোগ উঠেছিল সিপিএম সমর্খকদের বিরুদ্ধে।
ছোট আঙারিয়া গণহত্যা – ২০০১ সালের ৮ জানুয়ারি গড়বেতার ছোট আঙারিয়া গ্রামে ১১ জন তৃণমূল কর্মীকে খুন করে মাটিতে পুঁতে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। পরে কিছু কঙ্কাল উদ্ধার হয়েছিল ছোট আঙারিয়া থেকে।
জ্যোতি বসুর উত্তরসূরি হিসাবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য , যিনি ২০০০ সালের নভেম্বর মাসে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, তিনি তার শাসনকালে পরিস্থিতি নিজের আয়ত্তে আনলেও, তাঁর দ্বারা নতুন শিল্প স্থাপনের চেষ্টা পরিস্থিতিকে বিগড়ে দেয়। জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি উঠে আসে। নন্দীগ্রামে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের রাসায়নিক হাব স্থাপন করা নিয়ে সিপিআই(এম) এবং তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে বারংবার সংঘর্ষ হয়।
নন্দীগ্রাম গণহত্যা – এখানে দুটি গণহত্যা ঘটেছিল ২০০৭ সালে। ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ ভূমি উচ্ছেদ কমিটির মঞ্চে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন ১৪ জন। পরে ২০০৭ সালের ১০ নভেম্বর ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির মিছিলে গুলি চালিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। তাতে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ১০ জনের।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে, বুদ্ধদেব বাবুর শাসনামলের চূড়ান্ত বছরগুলিতে একটি আদর্শিক অবক্ষয়ের সাক্ষী হয় পশ্চিমবঙ্গ। দুর্নীতি আঞ্চলিক আধিপত্যের পিছনে চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যতক্ষণে বাম সরকার নিজেদের সামলানোর প্রচেষ্টা শুরু করে, ততদিনে পঞ্চায়েতি রাজ কয়েক হাজারের জন্য টাঁকশালে পরিণত হয়েছিল।
নেতাই গণহত্যা – ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ঝাড়গ্রামের নেতাইয়ের এক সিপিএম নেতার নির্দেশে সাধারণ মানুষের উপর গুলি চালিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। ৯ জন নিরীহ গ্রামবাসী সেই ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন।
২০১১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঠিকঠাক করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “আমরা প্রতিহিংসা নয়, পরিবর্তনের রাজনীতি নিয়ে আসব।” তবে হত্যা আর জমি দখলের যুদ্ধ থেমে থাকেনি। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, সিপিআই(এম)-এর প্রাক্তন বিধায়ক প্রদীপ তাহ এবং বর্ধমান জেলা নেতা কমল গায়েনকে হত্যা করা হয়, অভিযোগের আঙ্গুল ওঠে তৃণমূল কর্মীদের দিকে। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পরবর্তী ৯ মাসে সংঘটিত সংঘর্ষে সিপিআই(এম) নেতা ও শ্রমিকদের ৫৬ জন প্রান হারান।
২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন বাংলাকে পুরনো ইতিহাসের কথা স্বরণ করিয়েছিল। ভোটগ্রহণের দিনই মারা যান ১০ জন। তবে ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে সর্বকালের সর্বোচ্চ ৭৬ জন এবং ২০১৩ সালে ৩৯ জন প্রান হারিয়েছিলেন। এছাড়াও গণমাধ্যম এবং পুলিশের সামনেই ভোট কারচুপি, বুথ ক্যাপচার এবং ব্যালট পেপার জ্বালিয়ে দেওয়ার মত ঘটনার সাক্ষী হয় আমজনতা। ৩৪ শতাংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেছিল শাসক দল তৃনমূল। এই নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানের সূত্রপাত ঘটায়। অপর দিকে রাজ্যের আরেক উল্লেখযোগ্য শক্তি বামপন্থীদের রাজনৈতিক রক্তক্ষরন অব্যহতই থাকে।
২০২১এর হাইভোল্টেজ নির্বাচনের আগেও থেমে নেই হিংসা। একের পর এক হত্যার ঘটনা ঘটছে। প্রধান বিরোধী দল বিজেপির দাবী তাদের ১৪০ জন কর্মী-সমর্থককে খুন করা হয়েছে। অপর দিকে রাজ্যের নানানপ্রান্তে প্রাকনির্বাচনী হিংসার সূত্রপাত ঘটে গিয়েছে। যে বাংলার মনিষীরা আজও চেতনা জোগান জগৎজুড়ে সেই বাংলাতেই এমন হিংসা কেন? প্রশ্ন থাকলেও উত্তর মেলে না সহজে।
আরও পড়ুন কাতার বিশ্বকাপে নেই ইতালি, টানা দুবার নেই চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ানরা
আরও পড়ুন স্মৃতি ইরানির জন্মদিনে মৌনীর শুভেচ্ছা বার্তা, পূর্ণতা পেল অনস্ক্রিন কেমিস্ট্রি